প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৫, ১২:৩৩
আন্তর্বর্তী সরকারের প্রকাশিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের পক্ষে বা সমর্থনে কোনো প্রেস বিজ্ঞপ্তি, প্রচারণা, সংবাদ সম্মেলন, মিছিল, সভা কিংবা বক্তৃতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দলটির পক্ষে কোনো ধরনের প্রচারণা চালালে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে বলে স্পষ্ট করা হয়েছে। ফলে দেশের গণমাধ্যমগুলো পড়েছে জটিল এক আইনি দ্বিধার মুখে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ায় এখন থেকে আওয়ামী লীগের কোনো বক্তব্য, কর্মসূচি বা দলীয় ইতিহাস নিয়েও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, রাজনৈতিক দল একটি ‘সত্তা’ বা এনটিটি হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলে সেটি সমর্থন বা প্রচার করাও আইনের চোখে অপরাধ। তার মতে, এই নতুন সংযোজন শুধু গণমাধ্যম নয়, গবেষক ও ইতিহাসবিদদের কাজেও আইনি বাধা তৈরি করতে পারে।
আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সত্তার পক্ষে জনসম্মুখে কথা বলেন, সভা-সমাবেশ করেন বা সামাজিক মাধ্যমে কিছু প্রচার করেন, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ সাত বছর এবং সর্বনিম্ন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। পাশাপাশি আর্থিক জরিমানারও বিধান রাখা হয়েছে। এই ধারাটি কার্যকর হলে সংবাদ পরিবেশন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের।
নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো দিবস বা ঐতিহাসিক ঘটনাও সরাসরি প্রচার করা যাবে না। ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ইতিহাস কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান তুলে ধরার ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন আইনজীবীরা। ইতিহাস লিখতে গিয়ে দলটির নাম উল্লেখ করতে হলে 'কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ' এইভাবে উল্লেখ করতে হবে, তা না হলে হয়রানিমূলক মামলার মুখে পড়তে পারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সংশোধিত আইনটি আগের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের তুলনায় অধিক কঠোর। ২০০৯ সালে প্রণীত আইনে সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সুযোগ থাকলেও কোনো রাজনৈতিক দলের পূর্ণ কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিধান ছিল না। এবার প্রথমবারের মতো এ ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করল অন্তর্বর্তী সরকার, যার ফলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের পথ নতুনভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে যাচ্ছে।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত ও শিবিরের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছিল। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রলীগকেও নিষিদ্ধ করেছে একই আইনের আওতায়। ফলে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দমননীতি কেমন হবে, তা নিয়েও জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
তবে সরকার দাবি করেছে, এই সিদ্ধান্ত কোনো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য হুমকি নয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট এক রাজনৈতিক সত্তার জন্য প্রযোজ্য এবং তা অন্য দল বা মুক্তমতের উপর প্রভাব ফেলবে না। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনের এই প্রয়োগ পদ্ধতি ভবিষ্যতে মতপ্রকাশের অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
এই নতুন আইনি পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যম, গবেষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সামনে সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন বাস্তবতা। একদিকে ইতিহাস ও বাস্তবতা, অন্যদিকে আইনের কঠোরতা—এই দ্বন্দ্বের মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।