ইসলামে বিজয়ের আনন্দ ও তাৎপর্য

নিজস্ব প্রতিবেদক
ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: শুক্রবার ১৬ই ডিসেম্বর ২০২২ ১১:১৭ পূর্বাহ্ন
ইসলামে বিজয়ের আনন্দ ও তাৎপর্য

১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের বিজয় দিবস। এই দিনে অত্যাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ থেকে মুক্তি পায় বাংলার মানুষ। এ বিজয় শুধু আনন্দের নয়। এ বিজয় পরাধীনতার কবল থেকে মুক্তির। ইসলামেও রয়েছে স্বাধীনতার বিজয়ের ভাবনা।


ইসলামেও বিজয় দিবস উদযাপনে বিরোধিতা নেই। বরং দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বিজয় উদযাপন উপলক্ষে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করা এবং তারই কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করা, তারই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করাই ইসলাম দিকনির্দেশনা দেয়। হাদিসে পাকে এসেছে-


নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো ঘোষণাই দিয়েছেন-


حُبُّ الْوَطَنِ مِنَ الاِيْمَان


‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’


আর দেশকে ভালোবাসার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করে বিজয় অর্জন করা একই সুতোঁয় গাঁথা।


১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের ওপর শুরু হয় কামানের গোলাবর্ষণ। নিরস্ত্র বাংলাভাষী মানুষ পাকিস্তানি হায়েনাদের আতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা প্রায়। শুরু হয় মুক্তি সংগ্রাম। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রমে অসংখ্য প্রাণের আত্মদান, অত্যাচার-নির্যাতন ও কারাভোগের মাধ্যমে অবশেষে অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। আজকের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল। আজ ১৬ ডিসেম্বর; ঐতিহাসিক বিজয় দিবস।


বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যার নেতৃত্ব ও ত্যাগে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের এ দিনে বঙ্গবন্ধুসহ সব বীর শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং দোয়া।


এ দিবসে আনন্দ উদযাপন ও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। বরং ইতিহাস বিকৃত না করে দেশের জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এ দিবসটিকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করা জরুরি। পাশাপাশি দেশের বিজয়ের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে আত্মদানকারী সব শহিদদের স্মরণে দোয়া ও মুনাজাত করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের ঈমানের একান্ত দাবি।


যদিও বর্তমান সময়ে অনেকেই মনে করেন যে, বিজয় দিবস উদযাপন মানেই ইসলামের অবমাননা। বিষয়টি তা নয়; তবে সেটি হতে হবে ইসলামের নিয়মে। বিজয় দিবসের নামে অনৈসলামিক কোনো কার্যকলাপ হলে সেটি ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও বিজয় দিবস উদযাপন করেছিলেন।


তিনি ইসলাম প্রচারের কারণে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। দীর্ঘ ১০ বছর নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর সফলতার সঙ্গে নিজ মাতৃভূমি পবিত্র নগরী মক্কার স্বাধীনতা অর্জন করেন। অর্জন করেন মহান বিজয়।


নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেশ ত্যাগের সময় বার বার অশ্রুসিক্ত নয়নে জন্মভূমির দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন আর বলেছিলেন-হে প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা! আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার অধিবাসীরা যদি আমাকে অত্যাচার-নির্যাতন করে বিতাড়িত না করত; আমি তোমাকে ছেড়ে কখনো যেতাম না।’


দীর্ঘ ১০ বছর পর দশম হিজরিতে তিনি মক্কা বিজয় করেন। বিজয়ের পর তিনি আনন্দ উদযাপন করেছেন। বিজয়ে প্রথম আনন্দে তিনি আদায় করেছেন ৮ রাকাআত নামাজ।’ প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতায় তিনি এত বেশি খুশি হয়েছিলেন যা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। বিজয়ের আনন্দে তিনি সেদিন ঘোষণা করেছিলেন-


‘যারা কাবা ঘরে আশ্রয় নিবে তারা নিরাপদ। এভাবে মক্কার সম্ভ্রান্ত কয়েকটি পরিবারের ঘরে যারা আশ্রয় নিবে; তারা যত অত্যাচার নির্যাতনকারীই হোক তারাও নিরাপদ। এ ছিল প্রিয়নবির মক্কা বিজয়ের আনন্দ উৎসবের ঘোষণা।’


দেশ প্রেম যেমন ঈমানের অঙ্গ, তেমিন দেশের জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দেয়া আবশ্যক। বিজয় দিবসে দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্মানের সঙ্গে এ পতাকা উত্তোলন করাও ঈমানের দাবি। চাই হোক তা সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান; হোক তা মাদ্রাসা আর হোক তা মসজিদ।


বিজয় দিবস উদযাপনে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি যুযোপযোগী হাদিস তুলে ধরা হলো-


রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর পথে এক দিন ও এক রাত (দেশের) সীমানা পাহারা দেয়া এক মাসব্যাপী রোজা পালন ও এক মাসব্যাপী রাত জাগরণ করে নামাজ আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। আর এ অবস্থায় যদি ওই ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে; তবে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে; তার রিজিক অব্যাহত থাকবে;কবর ও হাশরে ওই ব্যক্তি ফেতনা থেকে মুক্ত থাকবে।’ (মুসলিম)


দেশপ্রেম, দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রহরা ও বিজয় দিবসে তাসবিহ, ক্ষমাপ্রার্থনা এবং আনন্দ উৎসবও দেশের প্রতিটি নাগরিকের আবশ্যকীয় কাজ। আর এ বিজয় দিবসে দেশের জন্য আত্মদানকারী সব শহিদদের জন্য দোয়া ও প্রার্থনা করা ঈমানের একান্ত দাবি। যেমনটি আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন-


‘(হে নবি!)যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে; আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন। তখন আপনি আপনার পালনকর্তার তাসবিহ তথা পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমা ও তাওবা কবুলকারী।’ (সুরা নসর)


সুতরাং আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপদরাধ বাংলা ভাষাভাষী মানুষ অত্যাচারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করবো। দেশের উন্নয়নে তার কাছে সাহায্য চাইবো। নিজেদের পরিশুদ্ধ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেও তার সাহায্য চাইবো। নিজেদের কে দেশ প্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলে প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনে সাহায্য চাইবো। দেশের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করবো। এমনটিই ইসলামের দিক-নির্দেশনা।


বিজয় দিবসে মহান আল্লাহ তাআলা প্রশংসা ও দেশের জন্য আত্মদানকারী সব শহিদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা দেশের সব নাগরিকের ঈমানের অকাট্য দাবি। বিজয় দিবসে এদেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো- বিজয় দিবস উদযাপনের পাশাপাশি স্বাধীনতার জন্য আত্ম ও অঙ্গদানকারী বীর সন্তানদের যথাযথ স্মরণ করা। স্বাধীনতার জন্য জীবন দেওয়া বীর শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা। তাদের পরিবার-পরিজনের খোঁজ-খবর নেওয়া। তাদের প্রতি সমবেদনা জানানো।


বিজয় দিবসে সব শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় একাত্মতা প্রকাশ করে দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত রাখাই হোক প্রতিটি নাগরিকের দৃপ্ত শপথ।