পানিচক্রে জীবন কাটে সূর্যভানুর

নিজস্ব প্রতিবেদক
জেলা প্রতিনিধি - বরগুনা
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ২৯শে জুলাই ২০২১ ০৫:৫৪ অপরাহ্ন
পানিচক্রে জীবন কাটে সূর্যভানুর

প্রচন্ড রোদ ছিল আকাশে। আর সেই রোদের তাপে শরীর ঘেমে পানি পড়ছিল এক নারীর। কলসিভর্তি পানি বোঝাই করে সিটবিহীন প্রায় অকোজো ভ্যানগাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একাই। কিছুদূর যেতেই সামনের এক চায়ের দোকানে থামেলেন তিনি। পরে কলসিভর্তি পানি নিয়ে দোকানের ড্রামে ঢাললেন। 



এভাবেই দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর যাবত পানি টেনেই সংসার চালান বরগুনার বেতাগী পৌরসভার বাসস্ট্যান্ড এলাকার সূর্যভানু বেগম। বয়স কত? এটা বলা তাঁর কাছে কঠিন। তবু জানান পঞ্চাশ, হয়তোবা তার বেশি।



সূর্যভানুর শুধু এটুকু মনে আছে, ১৩ কি ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল দিনমজুর আব্দুস ছোমেদের সাথে। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কোনোভাবে ঠেলেঠুলে তাদের সংসার চলছিল। ছেলেমেয়েরাও বড় হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সংসারে ছেদ পড়ে। 



প্রায় ১২ বছর আগে মারা যান স্বামী। এত দিন দুজনের শ্রমে, আয়-উপার্জনে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে যে সংসার চলছিল, সেই সংসারের পুরোটাই ঝুপ করে সূর্যভানুর কাঁধে এসে পড়ে। শুরু করেন মানুষের বাসায় ঝিঁয়ের কাজ।



স্বামীর মৃত্যুর পর সূর্যভানু বেগমের সংসারে শুরু হয় টানাপোড়ন। ছেলেমেয়েদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা। তাদের লেখাপড়া করানো। কী করবেন, ভেবে কোনো দিশা মিলছিল না। হাতের কাছে যা পেলেন, তাই মনে হলো আকাশের চাঁদ। শুরু করলেন বেতাগী পৌর শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার চায়ের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় পানি বিক্রি।



প্রতিদিন ভোর চারটায় ঘুম থেকে জেগে ওঠেন সূর্যভানু। পরিবারের অন্য সদস্যরা তখনো ঘুমে। পানির লাইনের কাছে ছুটে যান। দু-একজন নৈশপ্রহরী ছাড়া আর কোনো জনমানুষ তখন রাস্তায় থাকে না। এরপর একটা একটা করে ছোট-বড় কলসি ভরে তা রিকশাভ্যানে সাজিয়ে তোলেন। কলসিগুলো পানিতে ভরে ভ্যান ঠেলে নিয়ে আসেন বাজারের কাছে। তখনো দোকানিরা আসেন না। 



সূর্যভানু  নির্দিষ্ট স্থানে রাখা পানির পাত্র ভরে রাখেন। সকাল নয়টা পর্যন্ত তাঁর এই পানি সরবরাহের কাজ চলে। সব কটি স্থানে পানি ভরা শেষ হলে তাঁর দিনের ছুটি। পানির পাত্র অনুযায়ী মেলে দাম। নিচে ৫ টাকা এবং ওপরে ২০ টাকা। এতে প্রতিদিন তাঁর ৩০০ টাকার মতো আয় হয়। 



এই পানি বেঁচেই ১১ বছর ধরে তাঁর সংসার চলছে। দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে মো. শাহীন (২১) চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত আর মেয়ে মুন্নি (১৯) পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছেন। এ আয় থেকেই তিন বছর পূর্বে মেয়েকে বিয়েও দিয়েছেন সূর্যভানু। 



সূর্যভানু বলেন, ‘এগারো বছর ধরে এই কাজ করছি। মানুষের ছুটিছাটা আছে। আমার ঈদে-চান্দেও রেস্ট নাই। জীবনে তো কিচ্ছু নাই। কষ্ট করে পোলাপানগো বড় করছি। তবে এখন ব্যবসা নাই। দোকান কমে গেছে। আয়টাও তাই বাড়ছে না।’



বেতাগী বাসস্ট্যান্ড এলাকার ভাই ভাই সেলুনের উজ্জল শীল জানায়, বাসস্ট্যান্ডের সকল দোকানে একমাত্র পানি দেয় সূর্যভানু। এ জন্য শখ করে তাকে পানিমন্ত্রী বলে ডাকি। 



খাবার হোটেল মালিক শওকত হোসেন জানায়, সূর্যভানু অসুস্থ থাকলে আমাদের নিজেদের পানি আনতে হয়। এ জন্য একমাত্র ভরসা তিনি।



বেতাগী পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাসির উদ্দিন ফকির বলেন, 'স্বামী মারা যাবার পর থেকেই সূর্যভানু পানি বিক্রি করে সংসার চালিয়ে আসছেন। পৌরসভার পক্ষ থেকে তাকে বিভিন্ন সময় সাহায্য করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও এ সাহায্য অব্যাহত থাকবে।'



তবে রাতজাগা আর জলভেজা শীত-বর্ষার এই জীবন সূর্যভানু বেগমের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ফেলেই রেখেছে। কিন্তু তিনি সবসময় কথা বলেন হেসেখেলেই। হয়তো তিনি ধরেই নিয়েছেন পানি চক্রের এই জীবন থেকে তাঁর বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। এই পথ ধরেই যে তাঁকে বাকি জীবনের অনেকটা পথ যেতে হবে।