পদ্মা সেতুর সুফলবঞ্চিত দখিনের পেয়ারা চাষিরা !

নিজস্ব প্রতিবেদক
এইচ.এম.এ রাতুল, জেলা প্রতিনিধি, বরিশাল।
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ১৮ই আগস্ট ২০২২ ১০:৪০ পূর্বাহ্ন
পদ্মা সেতুর সুফলবঞ্চিত দখিনের পেয়ারা চাষিরা !

বরিশাল বিভাগের তিন জেলার ৫৫ গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় পেয়ারার। পিরোজপুরের আটঘর-কুড়িয়ানাকে পেয়ারার রাজ্য বলা হলেও পার্শ^বর্তী বরিশালের বানারীপাড়া এবং ঝালকাঠিতেও রয়েছে পেয়ারার সাম্রাজ্য। এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে পেয়ারা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন। আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খালজুড়ে পেয়ারার সমারোহ।


সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দ্রুততম সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রির জন্য নেয়া যাচ্ছে এই পেয়ারা। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ফলনও ভালো। তবে সঠিক পরিচর্যার অভাবে বেশিরভাগ পেয়ারা ছিটপড়া রোগে আক্রান্ত এবং আকারেও বেশ ছোট হওয়ায় ভালো দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। 


কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সার্বক্ষণিক মাঠে কৃষি কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীদের সহাতায় কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক প্রদান ও সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

এদিকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ফলে এবার পর্যটকদের চাপ কয়েকগুণ বেশি হবে বলে আশাবাদী এলাকার লোকজন। পর্যটকদের আগমনে বাড়বে পেয়ারার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়বে দামও। সে ক্ষেত্রে লোকসান কাটিয়ে আর্থিক সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখছেন পেয়ারার হাটের ব্যবসায়ীরা।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের বানারীপাড়া, ঝালকাঠি জেলার ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। বরিশাল জেলার বানারীপাড়ার ১৬ গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, ঝালকাঠি জেলার ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে, স্বরূপকাঠির ২৬ গ্রামের ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়।


এসব গ্রামের কয়েক হাজার কর্মজীবী পরিবার যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ করছে। পেয়ারার চাষ, ব্যবসা ও বাজারজাতকরণেও রয়েছে কয়েক হাজার মৌসুমি বেপারি এবং শ্রমিক। এ সময় অন্তত ২০টি স্থানে পেয়ারার মৌসুমি মোকামের সৃষ্টি হয়। এগুলো হলো- ভিমরুলী, আতাকাঠি, ডুমুরিয়া, গণপতিকাঠি, শতদশকাঠি, রাজাপুর, মাদ্রা, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, বর্ণপতিকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, আন্দাকুল, রায়েরহাট, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার, বাউকাঠি। এসব মোকামে মৌসুমে প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ হাজার মণ পেয়ারা কেনাবেচা হয়।


এ অঞ্চলের পেয়ারার আদি ইতিহাস থেকে জানা যায়, আনুমানিক ২০০ বছর আগে স্থানীয় কালীচরণ মজুমদার ভারতের ‘গয়া’ থেকে এই জাতের পেয়ারার বীজ এলাকায় রোপণ করেন। সেই থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে পেয়ারার চাষ। প্রবীণ পেয়ারা চাষিরা জানান, আগে বিচ্ছিন্ন আবাদ হলেও ১৯৪০ সাল থেকে শুরু হয়েছে পেয়ারার বাণিজ্যিক আবাদ, যা ক্রমশ বাড়ছে। মূলত জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে ভাদ্রের শেষ এই ৩ মাস পেয়ারার মৌসুম। তবে ভরা মৌসুম শ্রাবণ মাসজুড়ে। এরপর ক্রমশ কমতে থাকে পেয়ারার ফলন। চৈত্র-বৈশাখের মধ্যেই পেয়ারা চাষিরা বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 


চাষিরা জানান, পেয়ারা গাছে তেমন কোনো সার বা আলাদা করে কিছু দেয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু পরিচর্যাই যথেষ্ট। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেই পেয়ারা গাছে ফুল আসতে শুরু করে। তবে বৃষ্টি শুরু না হলে পেয়ারা পরিপক্ব হয় না। জমি ভালো হলে হেক্টরপ্রতি ১২ থেকে ১৪ টন পেয়ারার উৎপাদন হয়। বরিশালের বানারীপাড়া এবং ঝালকাঠি সদর উপজেলায় পেয়ারা চাষের বিস্তৃতি ঘটেছে। এ তিন উপজেলার ৩৫ গ্রামে গত এক যুগ ধরে চাষ হচ্ছে বাংলার আপেলখ্যাত পেয়ারার।


 কুড়িয়ানার পেয়ারা চাষি বঙ্কিম মণ্ডল বলেন, এ বছর বাগানে তেমন ফলন হয়নি। তার ওপর করোনার ভয়ে চাষিরা বাগানের যথাযথ পরিচর্যা করতে না পারায় ছিটপড়া রোগে আক্রান্ত হয়েছে প্রতিটি বাগান। যে কারণে এ বছর প্রতি মণ পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকায়। অথচ গত বছর প্রতি মণ পেয়ারা পাইকারি বিক্রি হয়েছে ৮০০-১,০০০ টাকায়।


এ ব্যাপারে পেয়ারা চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহর মণ্ডল জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর পেয়ারার ফলন ভালো হয়েছে। বাজারমূল্য কম হওয়ায় শত শত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। লোকসান গুনছেন চাষিরা। পেয়ারার ভাসমান হাট ক্রেতাশূন্য থাকায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে চাষিদের। লোকসানের আশঙ্কা দেখছেন কয়েক হাজার কৃষক।


জানা যায়, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানার বিখ্যাত পেয়ারা সরবরাহ হয় সারাদেশে। প্রতি বছর ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার পেয়ারা বিক্রি হতো। কিন্তু এ বছরে ফলন ভালো হলেও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে পেয়ারার ভরা মৌসুমেও বড় লোকসানের মুখে পড়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে ঝালকাঠি জেলা উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. ফজলুল হক ভোরের কাগজকে জানান, পেয়ারা বাগানে ফুল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সার্বক্ষণিক কৃষি কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীদের সহায়তায় কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হয়। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের দেয়া সার, কীটনাশক ও কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তা করছি।


স্বরূপকাঠি উপজেলা উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. নজরুল ইসলাম জানান, পেয়ারা বাগান ভিজিট করে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধান করব। চাষিরা যথাযথভাবে পরিচর্যা করতে না পারায় ছিটপড়া রোগের বিস্তার ঘটেছে। এ বছর পেয়ারা চাষিরা যাতে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেন এ জন্য তাদের বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশকের সহযোগিতা ও সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। অপরদিকে ভাসমান পেয়ারা হাট দেখতে বিদেশি পর্যটকসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা ভ্রমণ করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে। ইতোমধ্যে পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে পার্ক ও বিশ্রামাগার। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন পেয়ারা বাগান দেখতে। পর্যটকদের আনাগোনায় বেচাবিক্রি বাড়বে বলে এখনো আশাবাদী কৃষকরা।


এ ব্যাপারে স্বরূপকাঠি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোশারেফ হোসেন ভোরের কাগজকে জানান, পেয়ারা চাষিরা হতাশ হলেও তাদের বিশেষ প্রণোদনাসহ কৃষিবান্ধব সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। এ বছরে পেয়ারা চাষিরা যাতে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেন এ জন্য তাদের বিনামূল্যে উপকরণ (সার, কীটনাশক) সহযোগিতা ও সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে। বাংলার আপেলখ্যাত পেয়ারা বাগানের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।