প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ২০:১৮
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দিয়ে নতুন দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, যা দেশের রাজস্ব প্রশাসনে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চলেছে। 'রাজস্ব নীতি বিভাগ' ও 'রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ' নামের এই দুটি নতুন ইউনিট অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন থেকে আলাদা কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে জানানো হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে কর প্রশাসনে দীর্ঘদিনের অভিযোগ, অদক্ষতা এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব দূর করার একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
এনবিআরের বিলুপ্তি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে কিছু উদ্বেগ থাকলেও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। মঙ্গলবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এই সংস্কারের মাধ্যমে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানো হবে। একই দিন প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও প্রেসসচিবের পোস্টে জানানো হয়, সরকার এ পদক্ষেপকে একটি বৃহৎ কাঠামোগত সংস্কার হিসেবে বিবেচনা করছে।
নতুন এই দুই বিভাগের উদ্দেশ্য হলো—কর নীতিনির্ধারণ এবং কর প্রশাসনের কাজকে আলাদা করা। এতে করে স্বার্থের সংঘাত হ্রাস পাবে এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত এমন সময়ে এলো, যখন দেশের ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭.৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্নদের অন্যতম। বিশ্বব্যাপী এই অনুপাত গড়ে ১৬.৬ শতাংশ, আর মালয়েশিয়ায় এটি ১১.৬ শতাংশ।
বহু বছর ধরে এনবিআর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন, নীতিগত দুর্বলতা ও প্রশাসনিক অনিয়মের কারণে কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা হারিয়ে যাচ্ছে। একই ছাতার নিচে নীতিনির্ধারণ এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকায় দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব প্রকট হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা অনেক সময় কর ফাঁকিদাতাদের সাথে সমঝোতা করে নিজেরা সুবিধা নিচ্ছেন।
সরকারের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রেভিনিউ পলিসি ডিভিশন কাজ করবে কর আইন, হার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির দায়িত্ব নিয়ে। অন্যদিকে রেভিনিউ ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন দেখবে কর আদায়, নিরীক্ষা এবং কর পালনের বিষয়। এতে নীতিনির্ধারকরা সরাসরি রাজস্ব সংগ্রহে যুক্ত না থাকায় স্বার্থের সংঘাত অনেকটাই কমবে এবং দুর্নীতির সুযোগ কমে যাবে।
এছাড়া করজালের আওতা বাড়ানো, প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং দক্ষ পেশাজীবীদের সঠিক জায়গায় নিয়োগ নিশ্চিত করাও এই পুনর্গঠনের অংশ। সরকারের দাবি, স্বচ্ছ, পেশাদার ও তথ্যনির্ভর নীতিমালার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। ফলে, বেসরকারি খাতের মধ্যে যে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল, তা অনেকটাই দূর হবে।
সরকার আরও বলছে, এটি কেবল একটি প্রশাসনিক রদবদল নয়—বরং একটি কার্যকর, আধুনিক এবং ন্যায্য কর প্রশাসন গড়ে তোলার কৌশলগত পদক্ষেপ। এই পুনর্গঠন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী ও ভবিষ্যতমুখী করবে। জনগণের উন্নয়ন প্রত্যাশা পূরণে একটি দক্ষ ও স্বচ্ছ রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এটি এক অনিবার্য পদক্ষেপ।
সবশেষে অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের এই সাহসী সংস্কার উদ্যোগ যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, তবে তা দেশের সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন অভিযাত্রায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। এনবিআরের স্থানে নতুন এই কাঠামো কার্যকর হলে আগামী দিনের কর প্রশাসন হবে আরও প্রযুক্তিনির্ভর, স্বচ্ছ এবং গণমুখী।