শ্রীমঙ্গলে নিভৃত পল্লী রাধানগরে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনমান

নিজস্ব প্রতিবেদক
এহসান বিন মুজাহির জেলা প্রতিনিধি , মৌলভীবাজার
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ১১ই মার্চ ২০২৫ ০৫:২৯ অপরাহ্ন
শ্রীমঙ্গলে নিভৃত পল্লী রাধানগরে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনমান

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাধানগর গ্রামটি একসময় ছিল অজপাড়াগাঁ। পর্যটনের সুবাদে এখন দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছে। এ গ্রামের বাঁকে-বাঁকে গড়ে উঠেছে পাঁচতারকা মানের হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান এবং প্যারাগনসহ ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ত্রিশটি রিসোর্ট, হোটেল এবং ইকো-কটেজ। 


পর্যটনের ছোঁয়ায় এক দশকে বদলে গেছে নিভৃত পল্লী রাধানগর গ্রামের পুরো চিত্র। এখন দেশের অন্যতম পর্যটন গ্রাম হয়ে উঠেছে এই গ্রামটি। বদলে গেছে মানুষের জীবন-মানও। পর্যটনকেন্দ্রিক নানা ব্যবসায় এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজার হাজার মানুষের। দশ বছরে জায়গার দাম বেড়েছে অন্তত ৫০ গুণ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্যুরিজম ব্যবসায়ীরা এই গ্রামে এসে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন।


সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচতারা হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান দিয়ে শুরু এই গ্রামের সামনের অংশ। যতই এগিয়ে যাওয়া যায়, চোখে পড়ে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল ও ইকো-কটেজ। 


শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শ্রীমঙ্গল ঘুরতে আসা দেশি-বিদেশী পর্যটকদের একটা বড় অংশ রাতযাপন ও ঘুরে বেড়ানোর জন্য রাধানগরকেই বেছে নেন। প্রতিদিন অন্তত ৫০০ পর্যটক এই গ্রামের হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে আনাগোনা করেন। 


দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষেরা ব্যবসা করছেন এখানে। কেউ জায়গা কিনে রেখেছেন, কেউ নির্মাণকাজ শুরু করেছেন, কেউ রিসোর্ট দিয়েছেন, কেউ রেস্তোরাঁ, আবার কেউবা চাষ করছেন আনারস-লেবুর।


কটেজ ব্যবসায়ী মোঃ শামছুল হক জানান, আজ থেকে ১৫ বছর আগে রাধানগর গ্রামে প্রথম তিনি ইকো-কটেজ তৈরি করেন। এক সময় মুদি দোকানের পাশাপাশি লেবু বাগান গড়ে তুলেছিলেন তিনি। দিনে দিনে শ্রীমঙ্গল পর্যটনে সমৃদ্ধ হতে থাকায় তিনি বুঝতে পারেন, এই খাতে ব্যবসা হতে পারে লাভজনক। তাই পরীক্ষামূলকভাবে ২০০৭ সালে লেবু বাগানের ভেতরে এক রুমের একটি ইকো-কটেজ করেন। ভাবনার চেয়েও বেশি সাড়া পাওয়ায় পরে তিনটি কটেজ গড়ে তোলেন তিনি। ২০১৮ সালে এই কটেজের সামান্য দূরে ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আরেকজনের সঙ্গে মিলে নির্মাণ করেন আরও ৫টি কটেজ। গাড়িচালক, ট্যুর গাইডসহ অন্তত ২০০ মানুষের জীবিকার উৎস তার এখন এই কটেজগুলো।


পর্যটন বদলে দিয়েছে রাসেল আলমের জীবন। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি গৃহশিক্ষক হিসেবে পথচলা শুরু করেন। ২০০৫ সালে তিনিও আকৃষ্ট হন ইকোট্যুরিজমের প্রতি। প্রশিক্ষণ নিয়ে ট্যুর গাইড হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন রাসেল। কিছুদিনের মধ্যে তার আয় বাড়ে কয়েক গুণ। বর্তমানে পর্যটনের মৌসুমে মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করছেন রাসেল। তিনি জানান, তার আশপাশে এমন অন্ততত ১৫ জন গাইড আছেন, যাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে ট্যুরিজম। 


ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গ্রামে প্রতিদিন কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। পর্যটন খাতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ২০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। চা-শিল্পের পর পর্যটন খাতকেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিনিয়োগ যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে এই এলাকার জায়গার দাম।


২০১০ সাল থেকে এখানে পর্যটন ব্যবসা জনপ্রিয় হতে থাকে। ২০১৫ সালে তা বেগবান হয়। বর্তমানে প্রতিনিয়ত নতুন ব্যবসা তৈরি হচ্ছে পর্যটকদের মাথায় রেখে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন দেশি-বিদেশি খাবার হোটেল, হস্তশিল্পের দোকান, চা-পাতার দোকান।


আলাপকালে শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য বিশ্বজিৎ দেববর্মা জানান, ১০ থেকে ১৫ বছর আগে এখানে জায়গার দাম ছিল ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা শতক। এখন শতক ৫ থেকে ৬ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।


স্থানীয় ট্যুর গাইড শ্যামল দেব বর্মা জানান, পাখির চোখে দেখলে রাধানগর গ্রামটিকে মনে হবে এক শ্যামল সংরক্ষিত বনভূমি। কিন্তু এই গ্রামে এখন যে পরিমাণ আধুনিক হোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, গ্রামটি দেখলে মনে হবে যেন পর্যটন গ্রাম। দেশের বিদেশের পর্যটকদের অনেকেই এখানকার গ্র্যান্ড সুলতান, প্যারাগনসহ বিভিন্ন হোটেল-রিসোর্ট ও কটেজে রাত্রি যাপন করন এবং ঘোরাঘুরি করেন।


এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন দৈনিক খোলা কাগজকে জানান, পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোডের্র  উদ্যোগে এবং উপজেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় শ্রীমঙ্গলে দুই মাস আগেও ৩ দিনব্যাপী হারমোনি মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া ট্যুরিজমের জন্য উপজেলাটি সমৃদ্ধশালী অঞ্চল হওয়ায় এই অঞ্চলে ‘কমিউনিটি ট্যুরিজম’ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এখানকার ট্যুরিজমকে সমৃদ্ধ করতে পারলে স্থানীয় এবং পর্যটন সংশিষ্টরা অর্থনৈতিভাবে সমৃদ্ধ হবেন। এ ক্ষেত্রে পর্যটন একটি গ্রামের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা কীভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাধানগর গ্রাম।


এই গ্রামটি ইকো-ট্যুরিজমের ক্ষেত্রেও একটি দৃষ্টান্ত। দিন-রাত এখানে পর্যটকরা নিরাপদে চলতে পারেন। এই গ্রামকে কেন্দ্র করে যে পর্যটন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তার অর্থনৈতিক সুফল শ্রীমঙ্গল শহরসহ আশপাশের সব এলাকা পাচ্ছে।


ইউএনও আরও বলেন পর্যটকদের নিরাপত্তা এবং রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনা করে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে সোলার লাইট স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় পর্যাপ্ত লাইটের ব্যবস্থা করা হবে। খাসিয়াদের পান পুঞ্জিসহ শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন এলাকা পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমরা বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র আধুনিয়াকনসহ পর্যটকদের যথাযথ নিরাপত্তার ববস্থা করেছি।