কারাগারে বসেই সংসার চালাচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মঙ্গলবার ২০শে আগস্ট ২০১৯ ০৮:১২ অপরাহ্ন
কারাগারে বসেই সংসার চালাচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা

কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকলেও থেমে নেই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি। ব্যবসায়ীদের ফোনে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করছেন তারা। একই সঙ্গে কারাভ্যন্তরে মোবাইল ফোনের ‘কলরেটে’র জমজমাট ব্যবসা খুলে বসেছেন। তাদের কেউ কেউ আবার কারাগারে বসেই মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এ থেকে উপার্জিত টাকা দিয়ে কারাগারের বাইরে থাকা স্ত্রী-সন্তানদের ভরণপোষণসহ যাবতীয় খরচ চালাচ্ছেন এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী। কেউবা আবার এসব খাত থেকে আয় হওয়া টাকা দিয়ে কারাগারের বাইরে থাকা নিজ বাহিনীর সদস্যদের জন্য কিনছেন নতুন নতুন আগ্নেয়াস্ত্র। কারাবন্দি আসামিদের নজরদারির দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং দেশের বিভিন্ন কারাগারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

তারা জানান, সারা বছরই কারাবন্দি কয়েদিরা ফোনের মাধ্যমে চাঁদাবাজি করছেন। সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি করছেন কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি কয়েদিরা। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা কারাগারেও এমন চাঁদাবাজির তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ও নেত্রকোনা জেলা কারাগারের বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য প্রমাণ হাজির করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত একটি তদন্ত দল। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থাও নিয়েছে কারা প্রশাসন। তবে ঢাকা ও কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের বিষয়ে এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিরা কারাগারগুলোতে আলাদা আলাদা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। বিভিন্ন উৎসব ও দিবস ঘিরে মোবাইল ফোনে চাঁদাবাজির যেন মোচ্ছব চলে তাদের।

একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গুলশান ও বনানী এলাকার হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউজ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে থাকেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম ও আক্তার। তারা দুজনই কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। কারাবন্দি রাজধানীর রামপুরা এলাকার কাইল্যা পলাশ মোবাইল ফোনে ঈদুল আজহার আগে রামপুরা এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ীকে টাকার জন্য ফোন করেছিলেন বলে ভুক্তভোগী একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তারা নিজেদের পরিচয় জানাতে চাননি। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী জানে আলম দীর্ঘদিন ধরে বন্দি আছেন কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে। কারাগারে থেকেই তিনি নারায়ণগঞ্জ ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে টাকা দাবি করছেন।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জানে আলমের মতো আরও অনেকেই একই কৌশলে টাকা উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ কারাগারে বসে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া সন্ত্রাসীরা এসব তথ্য দিয়েছেন বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বর্তমানে মোবাইল ফোনে সবচেয়ে বেশি টাকা দাবি করা হচ্ছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ) ও কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। কারাবন্দিদের ওপর নজরদারির দায়িত্বে থাকা একটি গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানান, দুর্ধর্ষ কয়েদিদের একাধিক জোট রয়েছে। যারা জোটবদ্ধভাবে কারাগারের হাসপাতালে অবস্থান করে নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে রয়েছেন ধানম-ির ইমন, মোহাম্মদপুরের হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, পুরান ঢাকার সুমন, রামপুরার কাইল্যা পলাশ ও মহাখালীর আক্তার। এদের মধ্যে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জানে আলম। সম্প্রতি তিনি সেখান থেকে এক কয়েদিদের মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে চাঁদা চান নারায়ণগঞ্জের এক ডাইং ফ্যাক্টরি মালিকের কাছে। গোপনে ওই কারখানার মালিক টাকাও দিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকার এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা নিয়েছেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী সুমন। তিনি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বসেই পুরান ঢাকার গে-ারিয়া, সূত্রাপুর ও ইসলামপুর এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা কাইল্যা পলাশের স্ত্রী লামিয়া নিজে গিয়ে চাঁদার টাকা তোলেন রামপুরা, বনশ্রী ও আফতাবনগর এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। কারাগারে ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে পলাশ তার স্ত্রীর কাছে ব্যবসায়ীদের ঠিকানা এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেন। সেই অনুযায়ী তার স্ত্রী টাকা তুলে থাকেন। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘লামিয়া নিজেও একজন সন্ত্রাসী। তার সঙ্গে স্থানীয় অনেক হোমড়াচোমড়া ব্যক্তির সম্পর্ক থাকায় কেউ তাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন না।’ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জানে আলমের সঙ্গে সম্প্রতি মোবাইল ফোনে তার মেয়ের কথা বলার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, জানে আলমের কাছে তার মেয়ে ফোন দিয়ে বলে, ‘বাবা আমার স্কুলে ভর্তির টাকা লাগবে।’ জবাবে জানে আলম বলেন, ‘চিন্তা করো না মা, কয়েক দিন পরেই পাঠাচ্ছি।’

আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, মহাখালী এলাকার সন্ত্রাসী আক্তার কাশিমপুর কারাগারে যাওয়ার পর সেখান থেকেই স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণের খরচ জোগাচ্ছেন। সন্ত্রাসী ইমনের মা-বাবা দুজনই চিকিৎসক। তিনি চাঁদাবাজির টাকা দিয়ে কারাগারের বাইরে থাকা তার বাহিনীর সদস্যদের খরচ জোগানের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র কিনে থাকেন। কারাগারে বসে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন উপায়ে অর্থ আয়ের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার ও মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহম্মেদ বলেন, ‘কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ফোন ব্যবহারের নিয়ম নেই। তারপরও কারাগারে হাজতি ও কয়েদি সেলে নিয়মিত তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। অনেকের কাছে মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। যাদের কাছে মোবাইল ফোন পাওয়া যায়, তাদের বিষয়ে আদালতের কাছে অবহিত করা হয়।’

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আসামিদের আদালতে নিয়ে যাওয়ার পর তারা সেখান থেকে বিভিন্ন কৌশলে, বিশেষ করে পায়ের মোজার মধ্যে ছোট আকৃতির মোবাইল ফোন নিয়ে কারাগারে ঢোকার চেষ্টা করে দাবি করে এই কারা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মাঝে মধ্যেই হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে ভিজিট করতে আসেন। কিন্তু আমার এই দুই কারাগারে কোনো অনিয়মের তথ্য খুঁজে পাননি। আমার এখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম, তাজ ও ফ্রিডম রাসু রয়েছে। এদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা সেলে রেখে সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। কাজেই তাদের মাধ্যমে বাইরে ফোন করা অসম্ভব।’

অন্যদিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার (পার্ট-১) এবং কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার (পার্ট-২)-এর সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা বলেন, ‘আমি পার্ট-১ ও পার্ট-২-এর দায়িত্বে আছি। এই দুটি কারাগারে প্রায় এক হাজার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি রয়েছে। এছাড়া ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির সংখ্যা প্রায় আড়াইশো। এদের মধ্যে কাইল্যা পলাশসহ অনেক আলোচিত কয়েদি রয়েছে, যাদের কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। ফোন ব্যবহার থেকে শুরু করে যাতে অন্য কোনো ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড করতে না পারে সে বিষয়ে সবসময়ই সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেওয়া হয়। নিয়মিত তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনাকালে মাঝে মধ্যে কারও কাছে ফোন পাওয়া গেলে তাকে কঠোর শাস্তিও দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আসামি যখন কোর্টে যায় তখন তারা এই সুযোগ বেশি নিয়ে থাকতে পারে। আবার তাদের নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ ফোন করতে পারে। ভেতর থেকে বাইরে ফোন করার ঢালাও অভিযোগ সত্য নয়।’

‘ম্যাড পাহারাদার’ ও ‘মিয়া সাব’র মোবাইল ফোনে প্রতি মিনিট ১০০ টাকা: ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা একাধিক হাজতি জানান, এই কারাগারে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ও প্রভাবশালী কয়েদিকে ‘মিয়া সাব’ বানানো হয়। তার সঙ্গে কারা কর্মকর্তাদেরও সখ্য থাকে। তার মাধ্যমেই মূলত চলে মোবাইল ফোনে কথা বলা। এছাড়া কারাগারের নির্ধারিত একজন স্টাফের কাছে সংরক্ষিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আসামিরা প্রতিদিনই বাইরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। আবার কয়েদিরাও বিশেষ কৌশলে ফোন রেখে ভাড়া খাটান। যাদের ফোনে কথা বলতে প্রতি মিনিটে গুনতে হয় ১০০ টাকা। এই হিসাবে দিনে ১০০-১৫০ আসামি ২৪ ঘণ্টাই কথা বলার সুযোগ পেয়ে থাকেন। ছিঁচকে অপরাধী থেকে শুরু করে শীর্ষ সন্ত্রাসী সবাই এই মিয়া সাবের ফোনে কথা বলে বাইরে থাকা আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে অপরাধ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তবে প্রভাবশালী অনেকের আবার নিজস্ব মোবাইল ও সিম কার্ড থাকে। তারা বেশিরভাগ সময় নিজস্ব ফোন সেট দিয়েই কথা বলেন। প্রতিদিন এই ফোন ব্যবসার টাকা থেকে আয় হয় তিন থেকে চার লাখ টাকা। এই টাকার ভাগ কারাবন্দি দাগী কয়েদি থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কারা কর্মকর্তাদের পকেটে ঢোকে।

এ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আপনি তো সবই জানেন। তবে এ বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব।’ এরপর আর কোনো কথা না বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এই কারা কর্মকর্তা।

ইনিউজ ৭১/এম.আর