পিলখানায় দরবারে যোগ দিতে দেরি হয়ে যাবে- এই আশঙ্কায় বিডিআরের সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম সকালে নাশতা না খেয়েই বাসা থেকে বের হয়ে যান। ছোট মেয়ে ইতি ডেকেও থামাতে পারেনি তাকে। ওটাই ছিল বাবা-মেয়ের শেষ দেখা। বাবার সঙ্গে দেখা না করে আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান। পরীক্ষা শেষে দুপুরে জানতে পারেন, পিলখানায় গোলাগুলি হচ্ছে। দ্রুত তিনি বাসার উদ্দেশে রওনা হন। পিলখানার কোয়ার্টারে তখন কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। বাবার ফোনও বন্ধ। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় বাসায় মা-বোন। দিন পেরিয়ে রাত হয়, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া ছেলেটি প্রিয় বাবাকে খুঁজতে থাকেন পাগলের মতো। নৃশংস ঘটনাটির পরিসমাপ্তি ঘটে। ততক্ষণে বাবাকে জীবিত পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে লাশের আশায় ছুটলেন হান্নান। সাতদিন পর বাবাকে গণকবরে খুঁজে পেলেন। ছয় মাস পর জীবিত থাকা সেনা কর্মকর্তাদের বক্তব্যের সূত্র ধরে নুরুল ইসলামকে শহীদের মর্যাদা দেয় সরকার। সেনা কর্মকর্তারা জানান, পিলখানায় সেদিন হাজার হাজার জওয়ান বিদ্রোহ করে খুঁজে খুঁজে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে। আর বিদ্রোহীদের হত্যাযজ্ঞ প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন নুরুল ইসলাম। ২০০৯ সালের ২০ আগস্ট নুরুল ইসলামের কবরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন এবং পরে তাকে বিজিবির সর্বোচ্চ পদকে ভূষিত করা হয়।
এ বিষয়ে কথা বলার সময় বাবার স্মৃতিচারণ করে ছেলে আশরাফুল বলছিলেন, বাবার মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে নানা সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন তারা। মা, বোন, স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পিলখানায় (বর্তমান বিজিবির সদর দপ্তর) থাকেন। পিলখানার ঘটনায় শহীদ ৫৭ সেনা কর্মকর্তার পরিবারকে সরকারের তরফে ফ্ল্যাটের পরিবর্তে জায়গা দেওয়া হয়েছে। তাদের জায়গা দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষে বিজিবিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। বিজিবির দেওয়ার মতো স্থান না থাকার বিষয়টি জানালে সরকার গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে বলে। তারপর থেকে বিষয়টি বলা যায় ঝুলে আছে।
দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত শহীদ নুরুল ইসলামের স্ত্রী আয়েশা বেগম। ছয় মাস পর পর তাকে ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হচ্ছে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হলেও পিলখানায় ছোট্ট একটি কোয়ার্টারে থাকতে হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতেও নেই কোনো জমিজমা। ছেলে আশরাফুল বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আয়েশা বেগম বলেন, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু আমাদের থাকার কোনো জায়গা নেই।
আশরাফুল বলেন, ১০ বছর হয়ে গেলেও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্লট এখনও পাইনি। প্রতিশ্রুতির পরও সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো প্লট বরাদ্দে গড়িমসি কেন করছে, বুঝতে পারছি না। এজন্য ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখালেখি হলেও বিষয়টি সমাধান হয়নি। গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিজিবির মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি জানালে তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন। ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিজিবি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, রাজউক ৫০টিরও বেশি চিঠি চালাচালি করেছে। প্রতিটি দপ্তরই প্লট বরাদ্দের সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি।
জানা গেছে, সরকার গঠিত বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিজিবিতে চিঠি দেওয়া হয়। ডিওএইচএস থেকে বিজিবির জন্য প্লট দেওয়ার মতো সুযোগ না থাকায় বিজিবির পক্ষ থেকে বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হলে ফের গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। পরে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজউক চেয়ারম্যানকে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য বললেও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় রাজউক কোনো সমাধান করেনি। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিজিবির তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) শাহরীয়ার আহমেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে উত্তরা, ঝিলমিল অথবা পূর্বাচলে পাঁচ কাঠা জমি বরাদ্দের বিষয় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে জমি বরাদ্দের জন্য একটি চিঠি দেয়। শেষ পর্যন্ত জমি বরাদ্দের বিষয়টি রাজউকে আটকে আছে। এ প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, এ ধরনের কোনো আবেদন কখনও এসেছিল বলে মনে করতে পারছি না। তবে এরকম একজন শহীদ পরিবার প্লট পেতেই পারে। নিয়ম অনুযায়ী রাজউকের কাছে আবেদন এলে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে বিষয়টি তিনি দেখবেন বলে জানান।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।