বছরটা শুরু হলো খারাপ সংবাদ আবার একইসাথে ভালো সংবাদ দিয়ে। পহেলা বৈশাখ ১৪২৮, নববর্ষের প্রথম দিন। ঐদিন আবার মাহে রমজানের প্রথম দিন। এটা হলো ভালো সংবাদ। কিন্তু খারাপ সংবাদ হলো করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সরকার চলাচলে শর্তসাপেক্ষে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ২০২১ এর পহেলা বৈশাখ থেকে। স্থানীয়ভাবে এটা লকডাউন নামে পরিচিতি পায়।
সাহেদ একজন ঠিকাদার। তার বাড়ি নাজিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের দীঘিরজান গ্রামে। বাজার থেকে পুব দিকে পাকা রাস্তায় দেড় কিলোমিটার পরেই তাদের বাড়ি। সেখ বাড়ি। সেখ মোঃ সাহেদুর রহমান তার নাম। নাজিরপুরের উত্তরে টুঙ্গীপাড়া। টুঙ্গীপাড়ার শেখ আর নাজিরপুরের সেখ আলাদা। বানান আলাদা, হিসাবও আলাদা। নাজিরপুরে সেখদের নামে একটা ইউনিয়নই আছে, নাম সেখমাটিয়া। এটা আবার বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলা সংলগ্ন।
সাহেদ লেখাপড়া করেছে পিরোজপুরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে, হিসাববিজ্ঞানে। যদিও সাহেদ বিজ্ঞানসম্মতভাবে হিসাব-নিকেশ করতে জানে না, অথবা পারে না। জীবনের যাবতীয় হিসেব সে করে মানবিকভাবে। তার পড়া উচিত ছিলো হিসাবকলা ও মানবিকী বিভাগে। কিন্তু জানা যায়, এই নামে সোহরাওয়ার্দী কলেজ তো দূরের কথা, নিখিল বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে এরকম কোনো বিভাগ বা অনুষদ নেই। এটা নিয়ে ইউজিসি’র কাজ করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হিসাবকলা অনুষদ, বিভাগ বা নিদেনপক্ষে একটা কোর্স চালু করা দরকার। এদেশের লোক পড়ে হিসাববিজ্ঞান, কিন্তু জীবনের যাবতীয় হিসাব তারা করে স্বার্থ, লাভ ও ক্ষতির জটিল সমীকরণে। এখানে মানবিক হিসাবের বেশ আকাল দেখা যাচ্ছে। যারা একটু আধটু মানবিকভাবে জীবনের জটিল সমীকরণ মেলাতে চায়, তারা বেশ ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছে। লকডাউনে বাসায় শুয়ে শুয়ে সাহেদ এসব ভাবে। এরকম ভাবাভাবি এক প্রকার হিসাব যদিও হিসাববিজ্ঞানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।।
সাহেদ ঠিকাদারি করে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশীদের সাথে, সাবকন্ট্রাক্টে। এটা একটা মজার হিসাব। ধরুন মাটিভাংগা টুঙ্গীপাড়া মহাসড়কের কাজ সরকারিভাবে পেয়েছে হারুন সাহেব, কিন্তু সে কোনো কাজ করেনা। তার লাইসেন্স দিয়ে কাজ করে তার অনুগত রাজনৈতিক ভাই ব্রাদার। বিনিময়ে লাভের বড় অংশ কাজ না করেই পাবেন হারুন সাহেব। এটাকে সাবকন্ট্রাক্ট বলে। এটাই হিসাববিজ্ঞান, এটাই সায়েন্স।
সাহেদ হারুন সাহবের অনুগত ছোট ভাই। সে ঠিকাদারির এই হিসাববিজ্ঞানে ঢুকে গেছে, কিন্তু মনমতো হিসাব মিলাতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ করোনা ভাইরাস। ২০২০ এর মার্চে দেশে করোনা আক্রমনের পর থেকে সারা দুনিয়ায় অদ্ভুত স্থবিরতা চলছে, নাজিরপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানকার গ্রামীণ জনপদ অনেকটা পার্শ্ববর্তী কালীগঙ্গা নদীর মতো। জোয়ার ভাটা আছে, কিন্তু স্রোত নেই, এমনকি শ্রাবণ মাসেও প্লাবন নেই, অনেকটা সেরকম। করোনা এসে এই শান্ত জনপদকে আরও শান্ত করে তুলেছে। প্রশাসন, পুলিশ আর জরুরি সেবা ছাড়া বেশিরভাগ অফিস আর দোকানপাট বন্ধ। উন্নয়ন-মেরামত এসব কাজকর্মও বন্ধ। এক বছরের বেশি হয়ে গেলো সাহেদের হাতে তাই কোনো কাজকর্ম নাই। নিতান্তই বেকার অবস্থায় ঘরে বসা। একটু যে নাজিরপুর বাজার বা পিরোজপুর সদরে গিয়ে ইয়ার দোস্তদের সাথে দেখা করবে, সেই পরিস্থিতিও এখন আর নাই। আগে ছিলো লকডাউন, এখন এসেছে শাটডাউন, মানে সকল যাতায়াত বন্ধ। হেলমেট আর মাস্কসহ মটোরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামলেও মোড়ে পুলিশ আটকায়, তখন যাতনার শেষ থাকে না। আবার কখনও ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়তে হয়। তখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নানারকম নীতি-নৈতিকথা-সামাজিক দায়িত্বের কথা বলেন। বলা শেষ হওয়ার পর অর্থদণ্ড দেন অথবা বিবেচনা অনুযায়ী খালাস দেন। এই দণ্ড দেওয়া না দেওয়া একপ্রকার উচ্চমার্গীয় হিসাব যদিও হিসাববিজ্ঞানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
এর মধ্যে সাহেদের বউ গিয়েছে বাপের বাড়ি, দেউলবাড়ী, কিন্তু ফেরত আসার নাম নাই। সাহেদের বউ সামিহা। তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় পৌনে পাঁচ বছর কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা আলোর মুখ দেখে নাই, অথবা তারা বাচ্চাকাচ্চার মুখ দেখে নাই। সঠিক কোন ঘটনা এখানে ঘটেছে সাহেদ বা সামিহা কেউ তার হিসাব মিলাতে পারছে না।
এদিকে বাড়িতে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে দীঘিরজান বাজার থেকে একজোড়া ঘুঘু কিনে দিয়েছে সাহেদ। রাজঘুঘু। একটি পুরুষ অন্যটি নারী, ইংরেজি নাম Ring Dove। খুব সুন্দর। হালকা লালচে বাদামী আর গলার চারপাশে কালো রংয়ের রিং। সেখান থেকে নাম হয়েছে রিং ডাভ। আর বাংলায় রাজঘুঘু নাম হওয়ার কারণ এর অসাধারণ ডাক। বিশেষ করে দহন দুপুরে যখন চারিদিক ক্লান্ত-স্তব্ধ, তখন রাজঘুঘুর ডাক সুমধুর। দুপুরে ভাত খেয়ে শুয়ে শুয়ে সংসার নিয়ে এটাসেটা ভাবে সামিহা। রাজঘুঘুর ডাক এরকম সাধাসিধে ভাবনায় ভালো সাপোর্ট দেয়। চিন্তা গতিশীল হয়, এক চিন্তা লাফ দিয়ে অন্য চিন্তায় যাওয়া যায় খুব সহজেই। পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ করে ঘুঘুর বিরতিহীন বা বিরতিসহ ডাক।
সামিহারা দুই বোন, সে বড়। ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে পার্শ্ববর্তী স্বরূপকাঠী উপজেলায়, গত বছর। করোনার মধ্যেই। এজন্য কোনো আয়োজন করতে পারেনাই সামিহার আব্বা। ছোট মেয়েটাকে ঠিকভাবে তুলে দিতে পারলো না বিয়ের সময় এই কষ্টে প্রায়ই অনুশচনা করেন তিনি। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সামিহার ছোট বোন নিগার এক পুত্রসন্তানের মা হয়ে গেছে। এই নিয়ে দুই পরিবারে চাঁদের হাট বসেছে এখন। বিয়ের পরও নিগারের সাথে সামিহার নিয়মিত কথা হতো কিন্তু ইদানিং তেমন একটা আলাপচারিতা হয় না। এটিও একটি হিসাবের বিষয় যদিও হিসাববিজ্ঞানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
সামিহা বাপের বাড়িতে এসেছে প্রায় মাসখানেক। ঈদের পর, সাহেদ আসেনি, একাই এসেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে এক জোড়া রাজঘুঘু। সাহেদ এবার না আসায় সে রাগ করেছে, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাহেদ না এলে সে একাএকা আর সংসারে ফেরত যাবে না, সহজ হিসাব।
ঘুঘু খাঁচায় থাকে, নানানরকম ভঙ্গী করে ডাকে, অনবরত ডাকে। এদিকে ছোট বোন নিগার গত সপ্তাহে স্বামী-সন্তান নিয়ে এই করোনার মাঝেও স্বরূপকাঠী থেকে এসে বেড়িয়ে গেছে, দুই দিন ছিলো। নিগারের ছেলের বয়স দুই মাস। তার মিহি চীৎকার ঘুঘুর ডাকের চেয়েও হাজারগুণ মধুর লাগে সামিহার কাছে। এই হাজারগুণ মধুর লাগা একরকম হিসাবের বিষয় যদিও হিসাববিজ্ঞানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
সামিহার সাথে সাহেদের কথা হয়, দিনে চার পাঁচ বার, ফোনে অথবা ম্যাসেঞ্জারে। কথার ব্যাপ্তি খুব কম। তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় “কী করো?”; “খাইছো?”; “ঘুমাবা কখন?” প্রভৃতি। ইদানিং অবশ্য ঘুঘু নিয়ে কথা বলে তারা। ঘুঘু খাঁচায় রাখা ঠিক কীনা, এতে নিশ্চয় গুনাহ হবে, তিলা ঘুঘু ভালো ডাকে না রাজঘুঘু, ঘুঘু আর কবুতর এক কীনা, ঘুঘুর বাচ্চা হয় কতদিন পরপর এসব বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে তারা। এগুলোও এক ধরণের হিসাবের আলোচনা, যদিও হিসাববিজ্ঞানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ, শাটডাউন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক। রাস্তায় মটোরসাইকেল, অটোরিক্সা, রিকশা, ভ্যান যাতায়াত করছে। এমন এক সুন্দর সকালে ঘুম ভেঙে সামিহা দেখে ঘুঘুর খাঁচায় একটা ডিম। একটি ঘুঘু তাতে তা দিচ্ছে, অন্যটি অনবরত ডেকেই যাচ্ছে। বড় মিষ্টি আর উৎসবমুখর সে ডাক। সাহেদ ঘুঘুর খাঁচা খরিদ করেছিলো দীঘিরজান বাজার থেকে, মাত্র মাসখানেক আগে। এর মাঝে এই ঘটনা। সামিহা সাথে সাথে সাহেদকে ফোন দেয়। দিয়ে বলে, সে যেনো এক মুহূর্তও দেরি না করে তাকে নিতে আসে। বাপের বাড়িতে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটিও একটি হিসাবের বিষয় যদিও হিসাববিজ্ঞানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
সাহেদ দেরি না করে মটোরসাইকেল স্টার্ট দেয়। কালীগঙ্গা ব্রিজের উপর দিয়ে যেতে যেতে ভাবে হঠাৎ কী হলো সামিহার। সাতসকালে জরুরি তলব। সে হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র ছিলো, কিন্তু জগতের কোনো হিসাবই তার মেলে না। কিছুকিছু হিসাব না মেলাই ভালো। জীবন হিসাববিজ্ঞান না, হিসাবকলা আসলে। হিসাব মিলবে না- এটাই হিসাবকলার প্রথম পাঠ।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।