কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের পুটিয়াপাড়া গ্রামে দাঁড়িয়ে থাকা আড়াইশো বছরের প্রাচীন এক বটগাছ আজও গ্রামীণ ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে মাথা উঁচু করে আছে। এক সময় এই বটবৃক্ষকে ঘিরে চলতো ঐতিহ্যবাহী পুটিয়ার মেলা—যা এখন শুধুই স্মৃতির অংশ।
স্থানীয় প্রবীণদের ভাষ্যমতে, এই বটবৃক্ষটির বয়স প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ বছরেরও বেশি। বটগাছটির নিচে প্রতি বছর সরস্বতী পূজার সময় বসতো ‘পুটিয়ার মেলা’। গ্রামটির নামানুসারে মেলার নামকরণ করা হয়েছিল “পুটিয়ার মেলা”। ঐ সময় গ্রামটি ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত। সরস্বতী পূজাকে ঘিরে শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, গড়ে উঠতো সামাজিক মিলনমেলা।
গ্রামের প্রবীণ মোবারক হোসেন জানালেন, "মেলার সময় এমন উৎসবের আমেজ বিরাজ করতো যে মনে হতো ঈদের আনন্দ চলছে। আত্মীয়-স্বজনরা দূর দূরান্ত থেকে চলে আসতেন। খাবার, খেলনা, মাটির জিনিস, কাঠ ও বেতের সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি হতো। ঘোড়া দৌড়, গরুর গাড়ির প্রতিযোগিতাও হতো—যা ছিলো মেলার প্রধান আকর্ষণ।"
আতিকুর রহমান নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “আমরা ছোটবেলায় এই মেলায় যেতাম। মেলার দিনটা ছিল এক উৎসবের মত। এখনো বাবাদের মুখে শোনা গল্পগুলো কানে বাজে।”
তবে ১৯৮২ সালে ডিপ টিউবওয়েল প্রকল্পের আওতায় মেলার আশপাশের জমিগুলো চাষের আওতায় আনায় মেলার জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়ে। ক্রমে সেখানে কৃষিকাজ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে পুটিয়ার মেলার সমাপ্তি ঘটে। এ ছাড়াও সময়ের পরিক্রমায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনেকেই দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। বর্তমানে গ্রামটির জনসংখ্যার বড় অংশ মুসলিম।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) সকালে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, সেই প্রাচীন বটগাছটি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে, তবে গাছটিকে ঘিরে রয়েছে লতাপাতা এবং গাছের গোড়ার চারপাশে কোন প্রকার রক্ষণাবেক্ষণের ছাপ নেই। স্থানীয়দের মতে, এ গাছটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অংশ নয়, এটি পুটিয়াপাড়া গ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী।
স্থানীয় বাসিন্দারা এই বটগাছকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “এই গাছটি যেন কুসংস্কারের বলি হয়ে বিলুপ্ত না হয়ে যায়, সে দিকটি প্রশাসনকে গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।”
পুটিয়ার মেলা আর ফিরে না এলেও এই বটবৃক্ষ এখনও স্মরণ করিয়ে দেয় এক সময়কার প্রাণবন্ত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অংশগ্রহণমূলক গ্রামীণ উৎসবের ইতিহাস। এটি শুধু একটি গাছ নয়, বরং এক যুগের প্রতিনিধিত্বকারী ইতিহাসের জীবন্ত দলিল, যা সংরক্ষণের দাবিদার।