পাখির চোখে দেখলে ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া রেলস্টেশন এলাকার রেললাইন দেখে প্রথমে বোঝার উপায় নেই যে এটি আসলে একটি যোগাযোগমাধ্যম। বরং মনে হবে যেন লালগালিচায় ঢাকা কোনো রাজপথ। কাছে গেলে বোঝা যায়, এটি মরিচ শুকানোর বিস্তৃত মাঠে পরিণত হয়েছে। রেললাইনের দুই পাশ ও মাঝখানে মাদুর ও পাটি বিছিয়ে শুকানো হচ্ছে হাজার হাজার কেজি মরিচ। প্রতিদিন ভোরে এলাকার কৃষকরা মরিচ নিয়ে হাজির হন এই রেলপথে। এমন দৃশ্য রীতিমতো চমকপ্রদ।
চাষি এরশাদ আলী জানালেন, কাঁচা মরিচের দাম কম থাকায় তারা শুকিয়ে বিক্রি করেন। এতে বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়। প্রতি বছর মরিচ শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে দেশের নানা প্রান্তে পাঠানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় মরিচের মান যেমন বজায় থাকে, তেমনি কৃষকরাও পান ন্যায্য মূল্য। এর ফলে রেললাইনজুড়ে গড়ে উঠেছে মরিচের অস্থায়ী হাট।
মরিচ কিনতে আসা ব্যবসায়ী রমজান আলী বলেন, “ঠাকুরগাঁওয়ের মরিচ আকারে বড়, রঙে গাঢ় আর ঝাঁজে তীব্র হওয়ায় এর কদর সারাদেশে। এ অঞ্চলের মরিচ বাছাই করে আমরা ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই।” তাঁর মতে, প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার মরিচ কেনাবেচা হয় এই স্টেশন এলাকা থেকেই। এতে স্থানীয় কৃষকের আর্থিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে।
বগুড়া থেকে আসা ব্যবসায়ী মহসিন আলী জানান, “এই এলাকার মরিচ রঙ ও ঘ্রাণে অনন্য। গৃহিণীরা এই মরিচ চেনেন শুধু রঙ দেখেই। এখানে আসার কারণ একটাই—বিশ্বস্ত মান।”
রেললাইনের ধারে মরিচ শুকাতে আসা স্থানীয় কৃষক জাহাঙ্গীর আলম জানান, প্রতি বিঘায় তিনি ১০ থেকে ১২ মণ পর্যন্ত মরিচ পেয়েছেন। বর্তমান বাজারে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৫শ থেকে ৭ হাজার টাকায়। তাঁর হিসাবে বিঘাপ্রতি খরচ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা হলেও লাভের অঙ্ক যথেষ্ট সন্তোষজনক।
এই মরিচ উৎপাদন শুধু রুহিয়া স্টেশন ঘিরেই নয়, বরং জেলার হরিপুর, রাণীশংকৈল, পীরগঞ্জের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে চলছে মরিচ চাষ। বিভিন্ন জাতের মরিচের মধ্যে বাঁশ গাইয়া, জিরা, মল্লিকা, হট মাস্টারসহ হাইব্রিড জাতের চাষ বেশি হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৯৭০ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষ হয়েছে এবং এর মধ্যে ১ হাজার ৩২২ হেক্টরের মরিচ ইতিমধ্যে কাটা হয়েছে। গড় উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ১.৯২ মেট্রিক টন।
কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক আলমগীর কবীর বলেন, “আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছি। ফলন ভালো হয়েছে, দামও ভালো। কৃষকরাও খুশি। ঠাকুরগাঁওয়ের মাটি ও জলবায়ু মরিচ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।”
এই সাফল্য কেবল কৃষকের লাভ বাড়াচ্ছে না, বরং পুরো এলাকার অর্থনীতিকেও করছে গতিশীল।