কারও বিপদ হলে ‘আল্লাহ বিচার করেছেন’ বলা যাবে কি?

নিজস্ব প্রতিবেদক
ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: রবিবার ১২ই মার্চ ২০২৩ ১১:০২ পূর্বাহ্ন
কারও বিপদ হলে ‘আল্লাহ বিচার করেছেন’ বলা যাবে কি?

কখনো কখনো মানুষের বালা-মুসিবত, বিপদ-আপদ এবং জটিল ও কঠিন রোগব্যাধি হয়। কিন্তু মানুষের এসব রোগ-ব্যাধি বা বিপদ হলে এটাকে ‘আল্লাহর বিচার বা অভিশাপ’ হিসেবে মন্তব্য করা যাবে কি?


না, সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলা যাবে না। কেউ অসুস্থ হলে বা কঠিন বিপদের মুখোমুখি হলে ‘আল্লাহ নাফরমানির বিচার করেছেন’ এ কথা বলা যাবে না। কেননা কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির অসুস্থতা বা বিপদের বিষয়টি ঐশী বাণী কোরআন বা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়।


কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামিক স্কলারদের মত হলো- নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বিপদে আক্রান্ত হলে, তার ব্যাপারে এভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া যাবে না যে, অমুক কাজটির কারণেই তার এমন হয়েছে। কারণ এটি অজানা বিষয়। আল্লাহ তো আমাদের বলেননি যে, অমুক লোককে অমুক অপরাধের কারণে ওই শাস্তিটি দিয়েছি। তাই, এমনটি করা থেকে সতর্ক থাকতে হবে।


কোরআন-সুন্নাহর সতর্কতা


কঠিন রোগ-ব্যাধি ও বিপদ-আপদ সম্পর্কে কোরআন-সুন্নাহর বক্তব্য সুস্পষ্ট। আল্লাহ তাআলা মানুষকে তার অন্যায়-অপরাধের কারণে শাস্তি দেন যেমন সত্য, তেমনি অনেককে তিনি পরীক্ষা করার জন্যও রোগশোক, বিপদ-আপদ দিয়ে থাকেন। উভয় ব্যাপারে কোরআন ও সুন্নায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে পরীক্ষা করার বিষয়ে কুরআনে পাকে উল্লেখ করেন-


وَ لَنَبۡلُوَنَّکُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَاۤ اَصَابَتۡهُمۡ مُّصِیۡبَۃٌ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّا لِلّٰهِ وَ اِنَّاۤ اِلَیۡهِ رٰجِعُوۡنَ

‘‌নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং কিছু ধন-সম্পদ-প্রাণ ও ফলের ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষা করব। আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন। যারা তাদের ওপর কোনো বিপদ-আপদ আসে; তখন তারা বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চিতভাবে তার দিকেই ফিরে যাব।' (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫-১৫৬)


আর এ সব কঠিন বিপদে ওই বান্দা সবর করার পাশাপাশি ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়ে এবং আল্লাহর দরবারে মুসিবতের ধরণ অনুযায়ী সওয়াবের আশা করে। আল্লাহ তাআলা তাকে যে মুসিবতে আক্রান্ত করেন, তা সে মেনে নেয়। আর তখনই সে বান্দার জন্য বিপদ পরিমাণ সন্তুষ্টি ও পরিপূর্ণ সওয়াব নির্ধারিত হবে। হাদিসে পাকে এসেছে-


রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় বড় পুরষ্কার বড় মুসিবত তথা বিপদের বিনিময়ে পাওয়া যায়। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন তখন তার ওপর বিপদাপদ চাপিয়ে দেন। সুতরাং (বিপদের সময়) যে সন্তুষ্ট হবে, তার জন্য সন্তুষ্টি থাকবে; আর যে অসন্তুষ্ট হবে, তার জন্য (আল্লাহর পক্ষ থেকে) অসন্তুষ্টিই থাকবে।’ (তিরমিজি)


হজরত আবু সাঈদ খুদরি ও হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসলিম ব্যক্তির ওপর যেসব যাতনা রোগ ব্যধি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দুঃশ্চিন্তা কষ্ট ও পেরেশানি আপতিত হয়। এমন কি যে কাটা তার দেহে বিদ্ধ হয় এ সবের দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। (বুখারি)


নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘কোনো মুসলিম যখন কোনো কষ্টের মুখোমুখি হয়, তখন আল্লাহ তাআলা তার গোনাহগুলো এমনভাবে ঝেড়ে ফেলে দেন, যেমন গাছের পাতাগুলো ঝরে যায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)


আবার মানুষের কৃতকর্মের জন্য তাদের ওপর বিপদ-আপদ নেমে আসে এ সম্পর্কেও কোরআন-সুন্নায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-


ظَهَرَ الۡفَسَادُ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ بِمَا کَسَبَتۡ اَیۡدِی النَّاسِ لِیُذِیۡقَهُمۡ بَعۡضَ الَّذِیۡ عَمِلُوۡا لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ


মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে; যাতে ওদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি ওদের আস্বাদন করানো হয়। যাতে ওরা (সৎপথে) ফিরে আসে।’ (সুরা রূম : আয়াত ৪১)


হাদিসে পাকে কিছু অন্যায়ের সুস্পষ্ট শাস্তির কথা এভাবে ওঠে এসেছে-


হজরত ইমরান ইবনু হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এই উম্মতের জন্য (আজাব হিসেবে) ভূমিধ্বস, চেহারা বিকৃতি এবং পাথরবর্ষণ ঘটবে।’ এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো, হে আল্লাহর রাসুল! এগুলো কখন হবে? তিনি বলেন, ‘যখন (গায়ক) গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র বিস্তৃতি লাভ করবে এবং মদ্যপানের সয়লাব হবে।’ (তিরমিজি ২২১২)


তাই কোনো ব্যক্তিকে আক্রমণ করে বা দোষারোপ করে ‘আল্লাহর বিচার’ বলে আখ্যায়িত করা যাবে না। এভাবে ব্যক্তি বিশেষের অসুস্থতা ও বিপদের উপর কোরআন-সুন্নাহর প্রয়োগ করা গর্হিত কাজ। এটা কখনও আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি হিসেবে আবার কখনও পরীক্ষা হিসেবেও আসতে পারে। আল্লাহ অনেক সময় বান্দাকে বড় ধরনের বিপদে ফেলে তার গুনাহ ক্ষমা করেন, তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।


বিপদ থেকে বেঁচে থাকার দোয়া


নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ার যাবতীয় বিপদ ও মুসিবতে আল্লাহর দরবারে ধরণা দিতে শিখিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলিম ভাই মুসিবতে আক্রান্ত হয়; তারপর আল্লাহ তাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা বলে-


اِنَّا لِلَّهِ وَ اِنَّا اِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ – اَللَّهُمَّ اَجِرْنِىْ فِىْ مُصِيْبَتِىْ وَ اَخْلِفْ لِىْ خَيْرًا مِنْهَا


উচ্চারণ : ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহুম্মা আজিরনি ফি মুসিবাতি ওয়া আখলিফলি খাইরাম মিনহা।’


অর্থ : ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকেই ফিরে যাব। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আমার মুসিবতে সাওয়াব দান কর, আর আমার জন্য এর চেয়ে উত্তম বদলা দাও!।’


তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে আগের তুলনায় উত্তম প্রতিদান এবং বদলা দান করবেন।’অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন বান্দাকে আরও শিখিয়েছেন যে, যখন সে কোনো বিপদগ্রস্ত লোককে দেখবে, তখন এ দোয়া করবে-


اَلْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِىْ عَافَانِىْ مِمَّا ابْتَلَاكَ بِهِ – وَ فَضَّلَنِىْ عَلَى كَثِيْرٍ مِّمَنْ خَلَقَ تَفْضِيْلَا


উচ্চারণ : আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আফানি মিম্মানিবতালাকা বিহি; ওয়া ফাদ্দালানি আলা কাছিরিম মিম্মান খালাকা তাফদিলা।’


অর্থ : সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি তোমাকে বিপদাক্রান্ত করেছেন; তা থেকে আমাকে নিরাপদ রেখেছেন এবং আমাকে তিনি তার মাখলুক থেকে মাখলুকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।’


তখন তাকে এ মুসিবত কখনো স্পর্শ করবে না।’ (তিরমিজি)


আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার প্রতিটি ঘটনা, অসুস্থতা ও বিপদ-আপনকে মুসলিম উম্মাহর হেদায়েতের উপলক্ষ হিসেবে কবুল করুন। সবাইকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। সবাইকে সদা সুস্থ রাখুন এবং ঈমানের উপর মৃত্যু দিন। আমিন।