করোনার টিকা অর্ধেকই ধনীদের দখলে, কি হবে বাংলাদেশের?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: শুক্রবার ২৫শে সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৭:১৬ অপরাহ্ন
করোনার টিকা অর্ধেকই ধনীদের দখলে, কি হবে বাংলাদেশের?

করোনাভাইরাস মহামারি থেকে মুক্তি পেতে টিকার দিকেই তাকিয়ে আছে সারাবিশ্ব।এ পর্যন্ত কোনও টিকা অনুমোদন না পেলেও ধনী দেশগুলোর মাঝে অগ্রিম টিকা কেনার প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে।এ অসম প্রতিযোগিতায় দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশের সব মানুষের টিকা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।করোনাভাইরাসের কার্যকর কোনও টিকা এখনও আসেনি। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়েই অগ্রিম কোটি কোটি ডোজ কিনে রাখছে ধনী দেশগুলো।দাতব্য সংস্থা অক্সফামের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধনী দেশগুলো সম্ভাব্য টিকার উৎপাদন সক্ষমতার ৫১ শতাংশই কিনে ফেলেছে।কিন্তু ওই দেশগুলোতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষের বসবাস।

ধনী দেশের এই কাড়াকাড়ির কারণে আবিষ্কারে এগিয়ে থাকা ৫টি টিকাও যদি সফল হয় তবু ২০২২ সালের আগে বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ বা ৬১ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিতে পারবে না বলে সতর্ক করেছে অক্সফাম।আবিষ্কারে এগিয়ে থাকা ৫টি টিকাও যদি নিরাপদ প্রমাণিত এবং সফল হয় তারপরও এ অবস্থা সৃষ্টি হবে বলে সতর্ক করে অক্সফাম।চলমান জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের শুরুতে দেয়া বক্তব্যে টিকার আলাদা চুক্তিকে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ উল্লেখ করে একে অন্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন সংস্থাটির মহাসচিব।জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, সবাই নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত করোনাভাইরাস থেকে কেউ নিরাপদ নয়।

বিশ্বে এই মুহূর্তে ল্যাবে শত শত টিকা গবেষণা হচ্ছে তবে ৪০টি টিকা আছে হিউম্যান ট্রায়াল পর্যায়ে। ১০টি টিকা তৃতীয় ধাপে বড় জনগোষ্ঠীর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে যার মধ্যে চীন ও রাশিয়া ৫টি টিকা সীমিত আকারে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।আইসিডিডিআরবি’র এমিরেটাস বিজ্ঞানী এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা বিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ড. ফেরদৌসী কাদরী এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেছেন, ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য কিন্তু অনেক প্রতিযোগিতা হবে।গ্যাভি, সেপি, ডব্লিউএইচও এই প্রতিযোগিতার আশঙ্কা করেই কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি তৈরি করেছে।

তিনি বলেন, আমরা যদি চিন্তা করি এইচওয়ান এনওয়ান যেটা হয়েছিল প্যানডেমিক ১০ বছর আগে।সেখানে কিন্তু আমরা ভ্যাকসিন পাই নাই।কারণ সেখানে যেটা তৈরি হয়েছিল ভ্যাকসিন উন্নত দেশে চলে গিয়েছিল।আমরা অনেক পরে কিছু ডোজ পেয়েছিলাম তখন আর দরকার ছিল না।তার জন্য আমি মনে করি যে, যদিও অনেক চেষ্টা হচ্ছে বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতার মধ্যেই থাকবে। কারণ ভ্যাকসিনের উৎপাদন তো শতভাগ হবে না বলে জানান তিনি।করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের জন্য অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির দিকে তাদিকে আছে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে প্রচেষ্টা চলছে ২০২১ সালের মধ্যে ২০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন নিশ্চিত করার।

এর মধ্যে ১০০ কোটি ডোজ বরাদ্দ থাকবে ৯২টি নিম্ন আয়ের দেশের মানুষের জন্য। এ দেশগুলোয় পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বসবাস।বাংলাদেশও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির অধীনে প্রতিটা দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা দেয়ার পরিকল্পনা আছে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত ১৫৬টি দেশ কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতে ভ্যাকসিন সহযোগিতায় অংশীদার হয়েছে। কিন্তু এ কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি কতটা সফল হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সমীর কুমার সাহা বলেন, এখানে কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে।

তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জটা হলো এখানে সমতা আনাটা খুব কঠিন হবে।কারণ চীন জয়েন করেনি, আমেরিকাও কিন্তু জয়েন করেনি। যদি চীন ও আমেরিকা জয়েন করতো যেহেতু তারা গ্রেটেস্ট ইকোনমি, বড় দুটি দেশ, অর্থ তাদের আছে এবং তার থেকে বড় এই দুটি দেশেই কিন্তু বেশিরভাগ ভ্যাকসিন উৎপাদন হচ্ছে।সাহা বলেন,  সেখানেও কিন্তু আমরা আরেকটা বিপদের মধ্যে পড়ছি। নিম্ন আয়ের দেশগুলো কীভাবে এটাকে ম্যানেজ করবে সেটার একটা চিন্তা এবং এর বিতরণটা কিন্তু নিম্ন আয়ের দেশের জন্য আরও জটিল হয়ে যাবে বলে আমার কাছে মনে হয়।

বিজ্ঞান সাময়িকী ন্যাচার-এর রিপোর্টে দেখা যায়, তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে থাকা একাধিক ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটের কাছ থেকে ব্রিটেন নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য মাথাপিছু ৫ ডোজ ভ্যাকসিন অগ্রিম বুকিং দিয়েছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন জাপান অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ সম্ভাবনাময় ভ্যাকসিন মাথাপিছু একের অধিক ডোজ নিশ্চিত করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ন্যূনতম এক ডোজ নিশ্চিত করতে উদ্যোগী ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশও।

ভ্যাকসিন পেতে কি করছে বাংলাদেশ? করোনাভাইরাস মহামারি মোকবেলায় কার্যকর এবং নিরাপদ ভ্যাকসিনকেই শেষ ভরসা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ অবস্থায় ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ কি করছে এমন জিজ্ঞাসা অনেকের। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে একাধিক ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ তৎপর রয়েছে। এর জন্য অর্থ বরাদ্দও রাখা হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল মান্নান বলেন, এখানে ট্রায়াল হবে। আরও ট্রায়ালের জন্য যোগাযোগ করেছে। তিন-চারটি আছে পাইপলাইনে। সরকার অনুমোদন দিলে হবে। সরকার বসে নেই। উই আর ট্রাইং আওয়ার বেস্ট।
যদিও বাংলাদেশ প্রস্তুতির কথা বলছে, অনেক দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে কিন্তু ভ্যাকসিন ট্রায়াল নিয়ে দৃশ্যত অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। অনেক দেশই দ্রুত নিজদেশে ভ্যাকসিন ট্রায়াল শুরু করেছে। বাংলাদেশে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করায় চীনের ভ্যাকসিন যথাসময়ে ট্রায়াল শুরু করতে পারেনি।তাই যেকোনো ভ্যাকসিন প্রয়োগের আগে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ওপর তার ট্রায়াল করা জরুরি বলে মনে করছেন ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞরা। আর এত দ্রুত আর কোনও ভ্যাকসিন পৃথিবীতে এর আগে আসেনি।

কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বিএসএমএমইউ এর সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবেও মনে করেন যেকোনো ভ্যাকসিন প্রয়োগের আগে বাংলাদেশের মানুষের ওপর এর ট্রায়াল হওয়া দরকার।অন্যদিকে ভ্যাকসিন ট্রায়ালে যুক্ত হলেও টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার থাকে। আইসিডিডিআরবি চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের প্রস্তুতি নিচ্ছে।তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় থাকা অন্য আর কোনও ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের কোন চেষ্টা আছে কিনা জানতে চাইলে আইসিডিডিআরবির এমিরেটাস বিজ্ঞানী ও ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী কাদরী জানিয়েছেন, সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় ট্রায়ালের ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে গেছে।

তিনি বলেন, আমরা চাইলে যেকোনো ভ্যাকসিন আমরা ট্রায়াল করতে পারি। আমাদের ক্ষমতা আছে, আমাদের লোকবল আছে, আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে, অভিজ্ঞতা আছে, সবটাই আছে। আমরা সবটাই করতে পারবো। অক্সফোর্ডেরটাও করা উচিত। কিন্তু আমরা একা চাইলে তো হবে না। এটা যারা গবেষণা করছে তাদেরও আগ্রহ থাকতে হবে।ফেরদৌসী কাদরী বলেন, কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনের একটু পার্থক্য হচ্ছে এটা সবজায়গায় ছড়িয়ে গেছে। এটা শুধু এরকম ঝুঁকি না যে বাংলাদেশে আছে, যেমন রোটা ভাইরাস, কলেরা, টাইফয়েডেরও অনেক বেশি ঝুঁকি আছে যেটা অন্যান্য দেশে নেই।

তিনি বলেন, তার জন্য একটা ভ্যাকসিন যখন তৈরি হয় তখন তারা আমাদের দেশে করতে চায়, আমাদের মতো দেশে করতে চায়। কিন্তু এখন তো ফিল্ড অনেক বেশি আছে। এখন ব্রাজিলে চলে যেতে পারছে, সাউথ আফ্রিকায় চলে যেতে পারছে। তো আমাদের কিন্তু প্রতিযোগিতা অনেক বেশি।ভ্যাকসিনের এ প্রতিযোগিতার কারণে বাংলাদেশ সরকারকে ভ্যাকসিন বুকিং দেয়ার সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কমিটি সরকারকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতার কথা জানিয়েছে।গ্যাভির ভ্যাকসিন পেতে বেশ দেরি হওয়ার আশংকা থেকে বাংলাদেশেরও ভ্যাকসিন বুকিং করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছে কারিগরি পরামর্শক কমিটি।