কন্যা চাকরিপ্রার্থী, নিয়োগকর্তা পিতা!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: শুক্রবার ১৮ই জানুয়ারী ২০১৯ ০১:০০ অপরাহ্ন
কন্যা চাকরিপ্রার্থী, নিয়োগকর্তা পিতা!

নিয়োগ নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটতে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি)। সেখানে ছয়টি পদে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ নিয়োগ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য কমিশনের সচিব ড. মোহাম্মদ খালেদ; আর অন্যতম প্রার্থী তারই কন্যা সাদিয়া হোসেন সিনথিয়া। মেয়েকে নিয়োগ দিতে তিনি এরই মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছেন বলে অন্য প্রার্থীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে মোহাম্মদ খালেদ এ পরীক্ষার আয়োজন, কক্ষ পরিদর্শন, সম্মানী বণ্টন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও খাতা দেখার মতো স্পর্শকাতর কাজেও সম্পৃক্ত ছিলেন। অবশ্য তিনি দাবি করেছেন, খাতা দেখা ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সঙ্গে ছিলেন না। গত সোমবার এ নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ পেয়েছে। পরীক্ষায় সচিবের মেয়ে সাদিয়া হোসেন উত্তীর্ণ হয়েছেন। এ নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা হবে আগামী ২৩ জানুয়ারি বুধবার।

ইউজিসি সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ছয়টি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দিতে গত জুন মাসে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সহকারী সচিব/সহকারী পরিচালকের চারটি, প্রটোকল অফিসারের একটি ও সহকারী প্রটোকল অফিসারের একটি শূন্য পদে নিয়োগের জন্য এ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে আড়াই হাজার আবেদন জমা পড়ে। ইউজিসি কর্তৃপক্ষ আবেদনপত্র বাছাই করে লিখিত পরীক্ষার জন্য ১ হাজার ২০৪ জনের প্রবেশপত্র ইস্যু করে। তাদের মধ্যে সহকারী সচিব/সহকারী পরিচালকের চারটি পদেই আবেদন জমা পড়ে এক হাজার ৫৬ জনের। গত ২১ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ১১টায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এ নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা হয়। সেদিন ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দুটি কক্ষে ৮০ জন করে প্রার্থী বসানো হয়েছে। সর্বমোট ২৩টি কক্ষে ১ হাজার ২০৪ জনের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। দেখা যায়, নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে ইউজিসি সচিব ড. মোহাম্মদ খালেদ কক্ষ পরিদর্শন করছেন।

সহকারী পরিচালক, সহকারী সচিব (প্রটোকল) ও সহকারী প্রটোকল অফিসার পদে লিখিত পরীক্ষার ফল সোমবার ইউজিসির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এতে সহকারী পরিচালক পদে ইউজিসি সচিবের মেয়ে সাদিয়া হোসেন সিনথিয়াসহ ১৮ জন, সহকারী সচিব (প্রটোকল) পদে পাঁচজন এবং সহকারী প্রটোকল অফিসার পদে তিনজন উত্তীর্ণ হন। ইউজিসির ওয়েবসাইটে দেওয়া নোটিশে বলা হয়েছে, পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের `কম্পিউটার এপ্টিচিউড টেস্ট` হবে আগামী ২২ জানুয়ারি। পরদিন ২৩ জানুয়ারি সকাল ১০টা থেকে ইউজিসি চেয়ারম্যানের অফিসে নিয়োগের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হবে। উত্তীর্ণদের ইন্টারভিউ কার্ড তাদের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে বলেও জানানো হয়। একাধিক নিয়োগপ্রার্থী বলেন, নিজের মেয়ে প্রার্থী হওয়ায় ইউজিসি সচিবের নৈতিকভাবে উচিত ছিল, শুরু থেকেই বিভিন্ন দায়িত্ব পালন থেকে সরে যাওয়া। কিন্তু তিনি নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে প্রভাব খাটিয়েছেন। আড়াই হাজার প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ২০৪ জনকে লিখিত পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়। অন্যদের প্রবেশপত্রই ইস্যু করা হয়নি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় দৈনিকের একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক  জানান, তার স্ত্রীও সহকারী পরিচালক পদে আবেদন করেছিলেন। ঠুনকো অজুহাতে তার প্রবেশপত্র ইস্যু করা হয়নি। এই সাংবাদিক জানান, তার স্ত্রী একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। তার প্রতিষ্ঠানের ফরোয়ার্ডিং পত্র চাওয়া হয়েছিল। অথচ সরকারি নিয়োগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ফরোয়ার্ডিং কখনও প্রযোজ্য নয়। তা ছাড়া প্রবেশ পদে (এন্ট্রি পোস্ট) সেটি লাগেও না।

ইউজিসির একটি সূত্র জানায়, সচিবের কন্যা নিয়োগপ্রার্থী হওয়ায় এবার লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। চতুরতার সঙ্গে শুধু রোল নম্বর প্রকাশ করা হয়। অথচ অতীতে সবসময় উত্তীর্ণদের নাম ও রোল প্রকাশ করা হয়েছে। অন্য একটি সূত্র জানায়, এই লিখিত পরীক্ষার সপ্তাহখানেক আগে সচিব খালেদ প্রভাব খাটিয়ে তার কন্যা সিনথিয়াকে ইউজিসির আধা কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে চাকরি পাইয়ে দেন। ২১ ডিসেম্বর লিখিত নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার পর তিনি ইউজিসি থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া পরিচালক খন্দকার হামিদুর রহমানের ছেলের সঙ্গে তার এ মেয়ের বিয়ে দেন। বিয়েতে ইউজিসির চেয়ারম্যান, সদস্য ও কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. শাহ নওয়াজ আলী এবারের এই নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক। ইউজিসির অন্য সদস্যবৃন্দ, সচিব ড. মোহাম্মদ খালেদ ও পরিচালক সুলতান মাহমুদ ভূঁইয়া কমিটির সদস্য। কমিটির সদস্য সচিব হলেন ইউজিসির প্রশাসন বিভাগের উপসচিব ফজলুর রহমান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, এর সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না। নিয়োগের পুরো বিষয়টি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহ নওয়াজ আলী দেখছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।

নিয়োগ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শাহ নওয়াজ আলী বলেন, কমিশনের সচিবের কন্যা আবেদন করেছেন ও লিখিত পরীক্ষায় টিকেছেন। সচিব হিসেবে নৈতিকভাবে তার সন্তানকে এখানে আবেদন করানো সঠিক হয়নি বলেই মনে করি। এটি বিব্রতকর। সততা ও স্বচ্ছতার বিষয়টি এতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বাংলাদেশে বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার কন্যা যোগ্য হলে সব জায়গাতেই তার চাকরি হবে। তিনি বলেন, নিয়োগের খাতা দেখা ও অন্য বিষয়ের কাজ দায়িত্ব নিয়ে করেছি। সেখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। তারপরও বলব, এই পদে থেকে তার (সচিব) এখানে সন্তানকে আবেদন করানোই উচিত হয়নি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সচিব ড. মোহাম্মদ খালেদ জানান, তার কন্যা আবেদন করেছেন। লিখিত পরীক্ষায়ও টিকেছেন। এর সবই সত্যি। তবে তিনি নিয়োগের খাতা দেখা, প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ গোপনীয় কোনো কাজেই ছিলেন না। তিনি শুধু পরীক্ষা ও হল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, তার কন্যা আরও একবার ইউজিসিতে আবেদন করেছিলেন। সেবারও তার চাকরি দেওয়া হয়নি। কেন দেওয়া হলো না, তার কোনো ব্যাখ্যাও কেউ তাকে দিতে পারেনি। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ইউজিসি সচিব বলেন, ২২ বছর একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পর আমি কি এটুকু পেতে পারি না? আমার কন্যা তো আর অযোগ্য নয়! তিনি বলেন, আমি ভীষণ হতাশ! আই ফিল ডিপ্রাইভড। সমালোচনার ভয়ে আমার কন্যাকে চাকরি দেওয়া না হলে আমিও এবার দেখব, আমাদের কি কেউ নেই?

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব