শহীদ মেহেদী: পিতৃত্বের লোভে মায়ের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক
সামির আসাফ, প্রতিনিধি ( ঢাকা )
প্রকাশিত: সোমবার ২০শে জানুয়ারী ২০২৫ ১১:৩৫ পূর্বাহ্ন
শহীদ মেহেদী: পিতৃত্বের লোভে মায়ের বিরুদ্ধে মামলা

গত বছর জুলাই আন্দোলনের শহীদ ১৮ বছর বয়সী তরুণ ইমাম হাসান মেহেদী তার সংগ্রামী জীবন শেষ করার পর পরিবারে নতুন এক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। শহীদ মেহেদীর জন্মদাতা বাবা রিপন মিয়া, যিনি তার মা কুলসুম বেগম এবং ছয় বছর বয়সী মেহেদীকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে চলে গিয়েছিলেন, এখন তার সন্তান হয়ে শহীদ হওয়ার পর অনুদানের টাকা পাওয়ার জন্য মা এবং সৎবাবার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। মামলার তদন্ত চলছে, তবে পরিবারের সদস্যরা এটি পিতৃত্বের লোভে প্রতারণার অভিযোগ হিসেবে দেখছেন। 


মেহেদী রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় একটি কারখানায় কাজ করতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৯ জুলাই তিনি মহাখালী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি মোহাম্মদপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান। তার মৃত্যুর পর শহীদ পরিবার হিসেবে তার মা কুলসুম বেগম সরকার থেকে ১০ লাখ টাকা অনুদান পান, এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে আরও সহায়তা পাওয়া যায়। এই অর্থ দেখেই তার জন্মদাতা বাবা রিপন মিয়া হঠাৎ করে মামলার আবেদন করেছেন। 


তবে রিপন মিয়া এবং তার সন্তানের সম্পর্ক ছিল না দীর্ঘ সময় ধরে। ২০১২ সালে তিনি কুলসুম বেগমকে ডিভোর্স দেন এবং এরপর কখনোই মেহেদী কিংবা তার মাকে খোঁজেননি। এই পরিস্থিতিতে মেহেদী তার জীবনে সৎবাবা মোহামিন মিয়াকে পাশে পেয়েছিলেন এবং সে কারণেই তার জাতীয় পরিচয়পত্রে সৎবাবার নাম উল্লেখ ছিল। এই অবস্থা যখন রিপন মিয়া জানতে পারেন, তখন তার মনে পিতৃত্বের অনুভূতি জেগে ওঠে। তিনি মামলায় অভিযোগ করেছেন যে, তার পিতৃ পরিচয়ে মেহেদীর নাম বদলে সৎবাবা মোহামিন মিয়ার নাম করা হয়েছে এবং সে কারণেই তিনি মামলা দায়ের করেছেন।


এদিকে, মেহেদীর মা কুলসুম বেগম অভিযোগ করেছেন যে, রিপন মিয়া তার ছেলের মৃত্যুর পর একমাত্র অনুদানের টাকা পেতে এই মামলা করেছেন। তিনি বলেন, রিপন মিয়া একবারও তাদের খোঁজ নেননি, এমনকি তার ছেলের মৃত্যুর পরও তিনি হাসপাতালে গিয়ে তাকে দেখতে আসেননি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, রিপন মিয়া এখন শুধুমাত্র টাকার জন্য এই মামলা করেছেন। 


এদিকে, পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) মামলাটি তদন্ত করছে এবং তাদের মতে, মেহেদী জীবিত থাকাকালীনই সৎবাবার নাম দিয়ে তার এনআইডি তৈরি করেছিলেন। পিবিআই তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মেহেদীর প্রাথমিক স্কুলের সার্টিফিকেট, নাগরিকত্ব সনদপত্র এবং মৃত্যুসনদপত্রে রিপন মিয়ার নাম ছিল, কিন্তু এনআইডি কার্ডে সৎবাবার নাম লেখা ছিল। তারা মামলার তদন্তে কোন অপরাধের প্রমাণ মেলেনি বলে উল্লেখ করেছেন। 


তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই উপরিদর্শক রবিউল ইসলাম বলেছেন, মামলার বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল এবং এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তদন্তের সময় সকল প্রমাণ যাচাই করা হয়েছে, এবং সত্যতা মেলেনি যে অনুদানের টাকা নিয়ে কোনো প্রতারণা হয়েছে। তদন্তে জানা গেছে যে, মেহেদী কখনও তার পিতার পরিচয় ব্যবহার করেননি, বরং সৎবাবার নাম দিয়েই তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেছিলেন। 


এছাড়া, মেহেদীর মা কুলসুম বেগম অভিযোগ করেছেন যে, রিপন মিয়া শুধুমাত্র অনুদানের টাকার জন্য এই মামলা করেছেন। তিনি বলেন, "রিপন মিয়া আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কখনোই আমাদের খোঁজ নেননি, কিন্তু এখন টাকা পেতে তিনি মিথ্যা মামলা করেছেন।" 


তবে, তদন্ত সংস্থা পিবিআইর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, মামলার কোন অপরাধ প্রমাণিত হয়নি এবং আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। আদালত এখন মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। 


এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা যেখানে এক পিতা তার ছেলের শহীদ হওয়া পর তার খোঁজ না নিয়ে, শুধু আর্থিক স্বার্থে মামলা দায়ের করেছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযোগ করা হলেও, তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে, সত্য ঘটনা কিছুটা ভিন্ন। এর ফলে মেহেদীর পরিবার এখন আদালতে যাচাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে, যাতে এই মামলার সঠিক নিষ্পত্তি হতে পারে। 


মেহেদীর মা কুলসুম বেগম বলেছেন, "আমার ছেলের শহীদ হওয়ার পর এখন যদি কেউ তার লোভে মামলায় জড়ায়, তবে আমরা এর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই করবো।"