দেশের উত্তরের জনপদ দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী হাকিমপুর হিলি উপজেলা। ভৌগোলিক দিক থেকে উপজেলাটি তিনটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। এখানে প্রায় ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার লোকের জন্য একটি মাত্র ৫০ শয্যার হাসপাতাল। এই হাসপাতালে ছুটির দিন ব্যাতি রেখে প্রতিদিন তিন থেকে চার শতাধিক রোগী বর্হীর বিভাগ থেকে মাত্র পাঁচ টাকার টিকিটের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে। এসব রোগী সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি পেশা ও সব বয়সের রয়েছেন। গত কয়েক দিন থেকে ভাদ্র মাসের তীব্র ভ্যাপসা গরম ও আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ করে হিলি হাসপাতালে জ্বর সর্দি-কাশি ও পেটের ব্যাথা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ৫০ শয্যার হাসপাতালে রোগী ভর্তি আছেন ৬১ জন। রোগীর বেড ফাঁকা না থাকায় তৃতীয় তলার পুরুষ ওয়ার্ডে মেঝেতে ভর্তি থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে দেখা গেছে রোগীসহ তার লোকজনের। তবে আগের তুলনায় বর্তমানে হাসপাতালে জ্বর সর্দি কাশি, পেটের ব্যাথা ও ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের সঠিক চিকিৎসা সেবা ও পর্যাপ্ত ঔষধ বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে বলেই সব শ্রেণী পেশার রোগীরা হাসপাতাল মুখী বেশি হচ্ছেন বলে মনে করছেন চিকিৎসক।
চিকিৎসকরা বলছেন, হঠাৎ তীব্র গরম ও আবহাওয়া পরিবর্তন এর কারণে এমন সমস্যা হচ্ছে।
প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন রোগী ভর্তি থাকছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে। জ্বর, সর্দি কাশি, পেটের ব্যাথা ও ডায়রিয়া রোগীদের স্যালাইন, সঠিক চিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকসহ নার্সরা।
শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকাল এগারোটায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তৃতীয় তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে বেড ফাঁকা না থাকায় তিন জন রোগীকে মেঝেতে ভর্তি থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে দেখা গেছে। মহিলা ওয়ার্ডে ও কোন বেড ফাঁকা নেই। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে কিছু রোগী ভর্তি দেখা গেছে। তবে জ্বর সর্দি কাশি ও পেটের ব্যাথা রোগীর সংখ্যা বেশি। আবার শিশুর থেকে বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা এসব রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা কম দেখা গেছে।
হাসপাতালের রেকর্ড অনুসারে, ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার) দুই দিনে নতুন রোগীসহ মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিলো ৬১। আজ ১৬ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ৯ জন। অন্য দিকে আজ শনিবার হাসপাতাল থেকে ভর্তি রোগীর ছাড়পত্র (ছুটি) দিয়েছে ৩০ জন রোগীকে। অন্য দিকে হাসপাতালের বর্হি বিভাগে চার্ট-এর তথ্য মতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর পুরুষ, মহিলা ও শিশু ৩৮২ জন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগী পাঁচ টাকার টিকিটের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। আজ শনিবার দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত ২৪৫ জন পুরুষ, মহিলা ও শিশু রোগী টিকিটের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। বর্হি বিভাগে সাপ্তাহিক শুক্রবার ও সরকারি ছুটি ব্যাতি রেখে প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত টিকিটের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা ও বিনামূল্যে ঔষধ গ্রহণ করে থাকে হাসপাতালে আগত রোগীরা। তবে হাসপাতালে ডায়াবেটিস রোগীদের নতুন বহি সরবরাহ না থাকায় এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিয়ে ফিরে যেতে দেখা গেছে। হাসপাতালের বর্হির বিভাগে জ্বর সর্দি কাশি'র সিরাপ না পাওয়ার অভিযোগ ও পাওয়া গেছে।
হাসপাতালে কর্তব্যরত নার্স মাহফুজা খাতুন জানান, স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিদিন ৮-১০ জন নতুন রোগী ভর্তিসহ ৩০-৩৫ জন ভর্তি থাকে। কিন্তু গত কয়েক দিন থেকে হঠাৎ করেই জ্বর সর্দি কাশি ও পেটের ব্যাাথা রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। সাথে ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন জ্বর, সর্দি-কাশি, পেটের ব্যাথা, ও ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে ১৫-২০ জন করে রোগী ভর্তি নিতে হচ্ছে। জ্বর সর্দি কাশি ও পেটের ব্যাথায় আক্রান্তদের মধ্যে বয়স্ক পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা বেশি রয়েছেন। হঠাৎ করে আবহাওয়া পরিবর্তন, তীব্র গরম এর কারণে এমন সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
হাসপাতালে তৃতীয় তলার পুরুষ ওয়ার্ডে মেঝেতে ভর্তি হয়ে থাকা পার্শ্ববর্তী পাঁচবিবি উপজেলার মাঝিনা গ্রামের মেহেদী আলম বলেন, গত দুই দিন থেকে গায়ে জ্বর ও সর্দি কাশি। বাড়িতে প্রাথমিক অবস্থায় জ্বরের ঔষধ খেয়ে কাজ না হওয়া আজ সকালে হাসপাতালে এসেছি। এসে দেখি পুরুষ ওয়ার্ডে কোন বেড ফাঁকা নেই। তাই বেড ফাঁকা না থাকায় মেঝেতে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি। হাসপাতাল থেকে সরকারি স্যালাইন ও ঔষধ দিয়েছে।বর্তমানে একটু ভালো মনে হচ্ছে।
হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে মেঝেতে উপজেলার বোয়ালদাড় গ্রামের বিকাশ চন্দ্র চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। মেঝেতে তার পাশে বসে আছে তার স্ত্রী। এসময় তার স্ত্রী বলেন দুই দিন থেকে হঠাৎ করে জ্বর ও সর্দি কাশি বাড়িতে জ্বরের ঔষধ খেয়ে কাজ না হওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। বেড ফাঁকা না থাকায় মেঝেতে স্বামীকে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করছি।
হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি উপজেলার বানিয়াল গ্রামের ৯২ বছর বয়সী মজিদা বেওয়া বলেন, গত বুধবার জ্বর সর্দি কাশি ও পেটের ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। কোন কিছু খেতে পারছি না। মুখের স্বাদটাও নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে স্যালাইন দিয়েছে তারপর ঔষধ ও দিয়েছে। এখন অনেকটা সুস্থ।
হাসপাতালের বর্হির বিভাগে ঔষধ নিতে আসা নদী আক্তার বলেন, আমি ও আমার ১৫ মাস বয়সের ছেলের ঔষধ এর টিকিট সংগ্রহ করেছিলাম ডাক্তার এর কাছ থেকে ঔষধ এর নাম লিখে নিয়ে বর্হির বিভাগের কাউন্টারে গেলে তারা বলেন, বর্তমানে শিশুদের জ্বর সর্দি কাশির সিরাপ নেই। তবে আমার ও আমার ছেলের এন্টিবায়োটিক ঔষধ দিয়েছে।
হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে বর্হির বিভাগে চার্জ এর দ্বায়িত্ব পালনকারি ডাক্তার তন্ময় সরকার জানান, হাসপাতালে বর্তমানে বর্হির বিভাগের দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত লোক না থাকায় এবিষয়টা দেখা শুনা করছি।
তিনি জানান, আগের তুলনায় বর্তমানে হাসপাতালে বর্হির বিভাগে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত আগত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি দিন চার থেকে পাঁচ শতাধিক পুরুষ মহিলা ও শিশু রোগী ফ্রী চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ গ্রহণ করে থাকেন।
শিশুদের জ্বর সর্দি কাশি সিরাপ বর্হির বিভাগে নেই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, শিশুদের সিরাপ নেই এটা সঠিক না। আসলে বর্হির বিভাগে ঔষধ গুলো আমরা রেশনিং পদ্ধতিতে দিয়ে থাকি। যেমন স্টোর থেকে ঔষধ বর্হির বিভাগে আনতে দুই জন লোক দরকার। কিন্তু কোন লোক নাই। ফলে একটা দুইটা ঔষধ শেষ হলে যারা দ্বায়িত্বে আছেন তারা নিয়ে আসতে চায় না। তারা আজকের হিসাব দুপুর একটায় বুঝিয়ে দিয়ে পরের দিন সব ঔষধ একসাথে নিয়ে আসে। বিধায় যে সমস্ত রোগীরা আগে আসে তারা ঠিকই পান। পরে আসলে আর পায় না এটাই হচ্ছে বিষয়! যে ঔষধ গুলো স্টোর রুমে থাকে না সেগুলো আমরা মার্ক করে রাখি।
ডায়াবেটিস রোগীদের নতুন বই এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আগে হাসপাতালে ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় রোগীরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতেন। এখন বর্তমানে হাসপাতালে ডায়াবেটিস রোগীদের বই দেওয়া হয়েছে। তাই যাদের আগের থেকে বই দেওয়া আছে তারা সবাই নিয়মিত চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ পাচ্ছেন। নতুন বই সরবরাহ না থাকায় নতুন রোগীরা ঔষধ ও চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। এখানে আমাদের করণীয় কিছুই নাই। নতুন বই সরবরাহ হলেই এ সমস্যার সমাধান হবে। আমরা উর্ধতন কতৃপক্ষের নিকট বিষয়টি অবগত করেছি এখন সমাধানের অপেক্ষায়।
হাকিমপুর হিলি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এর সহকারী সার্জন ডাক্তার প্রিতম মুজতাহিদ জানান, আমার মতে হাসপাতালে জ্বর সর্দি কাশিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে এটা সঠিক না। বর্তমানে হাসপাতালে বিভিন্ন রোগের সঠিক চিকিৎসা সেবা ও পর্যাপ্ত ফ্রি ঔষধ পাওয়ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগী হাসপাতাল মুখী বেশি হয়েছে বলে আমি মনে করছি।
তিনি আরও জানান, গত কয়েক দিন থেকে ভাদ্র মাসের তীব্র গরম ও আবহাওয়া পরিবর্তন এর কারণে মূলত জ্বর সর্দি কাশি ও পেটের ব্যাথায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। তবে আমাদের হাসপাতালে স্যালাইন ও পর্যাপ্ত ঔষধ থাকায় এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা হচ্ছে না। অনেক রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে তীব্র গরমে সাবধান থাকতে হবে এবং ভালো ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। সেই সাথে খাবারের আগে সাবান দিয়ে হাত ভালো ভাবে ধৌত করতে হবে এবং অবশিষ্ট খাবার ভালো ভাবে ঢেকে রাখতে হবে। দুই তিন দিনের বেশি জ্বরে আক্রান্ত ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে এসে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে বলে জানান তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।