সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা : বন বিভাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: শুক্রবার ২৯শে জুলাই ২০২২ ০২:৪৭ অপরাহ্ন
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা : বন বিভাগ

বিশ্ব বাঘ দিবস আজ। সারাদেশের মতো বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে দিবসটি। বাগেরহাটের সুন্দরবনঘেষা মোংলা ও শরণখোলায়ও দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ আছে ১১৪টি। যদিও ২০১৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত বয়সের কারণে মারা গেছে কয়েকটি বাঘ। একই সঙ্গে চোরা শিকারি ও পাচারকারী চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বাঘের চামড়াসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।


২০২২ সালের দিকে আবারও পুনরায় বাঘ গণনা শুরু করা হচ্ছে। এই জরিপে বাঘের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, সর্বশেষ গণনায় সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ ছিল। গেল দেড় বছরে সুন্দরবনে যেভাবে বাঘ দেখা গেছে, আশা করছি সুন্দরবনে এবার বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।


কয়েক দফায় সুন্দরবন ভ্রমণে আসা পর্যটকরা বাঘের দেখা পেয়েছেন। আবার সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়েও বাঘ চলে এসেছে। একই সঙ্গে বনবিভাগের সদস্যরা সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে বাঘের উপস্থিতি টের পেয়েছেন। এ থেকে অনুমান করা হচ্ছে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।বলছেন, লোকালয়ে বাঘ আসার অর্থ বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।


পরিবেশবাদীদের দাবি, চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য, সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরাসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে হুমকির মুখে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তারা বলছেন, সুন্দরবনই হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্য প্রাণীর বৃহত্তম আবাসভূমি। বন বিভাগ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমিকে তাদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ করতে পারেনি। সুন্দরবনকে বন্য প্রাণীদের জন্য নিরাপদ করা গেলে দ্রুত বাঘের সংখ্যা বাড়বে।আর বনবিভাগ বলছে, সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণে সরকারিভাবে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।


সুন্দরবন বিভাগের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে রর্বাট হনড্রেকিসের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। এরপর ১৯৮২ সালে মার্গারেট স্যালটার জরিপে ৪২৫টি ও এর দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানায় বনবিভাগ। পরের বছর ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনের ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্যাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে ৩৬২টি বাঘের তথ্য পাওয়া যায়।


২০০৪ সালে জরিপে বাঘরে সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। ১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৫০টি থেকে ৪০০টি। ওই সময়ে বাঘের পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে গণনা করা হয়। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদশে অংশে বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে দাঁড়ায় ১০৬টিতে। হঠাৎ করে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪০০টি থেকে ১০৬টিতে এসে দাঁড়ালে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। ২০১৮ সালের সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১০৬ থেকে বেড়ে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪টিতে।


সুন্দরবন বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে মাত্র ১০টি। ১৪টি বাঘ পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয় জনতা। একটি নিহত হয়েছে ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোনসিডরে ও বাকি ২৫ বাঘ হত্যা করেছে চোরা শিকারিরা।


২০১৯ সালের ২০ আগস্ট সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের ছাপরাখালি এলাকা থেকে একটি পূর্ণ বয়স্ক বাঘিনীর মরদেহ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্তের পর জানা যায় বাঘটির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কবরখালী খালের চর থেকে একটি কুমিরে খাওয়া বাঘের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যার অর্ধেক অংশ কুমিরে খাওয়া ও বাকি অংশ পঁচা ছিল। ২০ বছর বয়সি বাঘটির বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে।


২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি রাতে বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে র‌্যাব ও বনবিভাগ যৌথ অভিযানে বাঘের চামড়াসহ গাউস ফকিরকে (৫২) আটক করে। পেশাদার চোরা শিকারি গাউস ফকির সুন্দরবন থেকে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করে ৮ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা ও ৩ ফুট ১ ইঞ্চি চওড়া চামড়াটির ১৭ লাখ টাকা বিক্রির চেষ্টা করে। পরে ক্রেতা সেজে তাকে আটক করা হয়।


এ বছরের ১৯ মার্চ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইটের অভয়ারণ্যের ধনচে-বাড়িয়াচর এলাকার ভোলা নদীর চর থেকে ৭ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রাপ্তবয়স্ক একটি মৃত রয়েল বেঙ্গল টাইগার উদ্ধার করা হয়। ১৫ বছর বয়সী এই মাদী বাঘটি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয়।


একই বছরের ১১ ডিসেম্বর বাগেরহাটের ফকিরহাটে বাঘের চামড়াসহ খুলনার ডুমুরিয়া কাঞ্চনপুর এলাকার মৃত কোরেশ মাহমুদের ছেলে মো. আজিজুর রহমান (৪৫) ও খুলনার সোনাডাঙ্গা থানার গ্রামীন আবাসিক এলাকার মো. জামাল খানের ছেলে মো. সাইদ খানকে (৩৫) আটক করে র‌্যাব। ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালী বাজার এলাকায় সুন্দরবনের ঐতিহ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এই দুই পাচারকারীকে আটক করলেও বাকিরা পালিয়ে যায়।


২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলারচর থেকে ৯ ফুট লম্বা একটি বাঘের মরদেহ উদ্ধার করে বনবিভাগ। পানি পান করতে খালে নেমে কাঁদায় আটকে বাঘটি মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।তবে আশার কথা হচ্ছে, কয়েক দফায় সুন্দরবন ভ্রমণে আসা পর্যটকরা বাঘের ভিডিও ধারণ করেছেন। আবার সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়েও বাঘ চলে এসেছে। বনবিভাগের সদস্যরা সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে বাঘের উপস্থিতি টের পেয়েছেন।


এ বছরের ১২ মার্চ এমএল সুবতি নামের পর্যটকবাহী লঞ্চে ঢাকা থেকে সুন্দরবন ঘুরতে আসেন ৩০ জন পর্যটক পরিবারসহ বাঘের দেখা পান। সুন্দরবনের কটকা ও কচিখালির মধ্যবর্তী স্থানে এলে তারা দেখতে একসঙ্গে ৫টি বাঘ নদীর চরে গোল গাছের পাশে বসে রয়েছে এবং খেলা করছে।২০২০ সালের ৭ অক্টোবর একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ভারাট হওয়া ভোলা নদী পার হয়ে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের পশ্চিম রাজাপুর গ্রামে আসে।


২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি রাতে সুন্দরবন থেকে একটি বাঘ বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামে ঢুকে পড়ে। বাঘটি ওই গ্রামের প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিচরণ শেষে আবার সুন্দরবনে ফিরে যায়। বাঘের পায়ের অসংখ্য ছাপ ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, নদীর চরে নজরে আসে গ্রামবাসীর।


২০২২ সালের ৫ মে রাতে শরণখোলায় সুন্দরবনের একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার (বাঘ) হানা দেয়। সুন্দরবন থেকে দুই কিলোমিটার দূরে শরণখোলা উপজেলার খেজুরবাড়িয়া গ্রামের শাহিন খান নিজ ঘেরের মধ্যে বাঘটিকে শোয়া অবস্থায় দেখা যায়।


সুন্দরবন করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির জানান, বাঘ একটি নিদৃষ্ট গণ্ডির মধ্যে চলাচল করে। যখন বাঘটির বয়স হয়ে যায় তখন অন্য বাঘ সেটাকে তাড়িয়ে দেয়। তখন সে অন্য দিকে চলে যায়। সেখান থেকেও তাকে তাড়িয়ে দিলে সে লোকালয়ে চলে আসতে পারে। সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে বনরক্ষীরা বাঘের উপস্থিতি টের পেয়েছেন বলে জানানো হয়।


বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাট জেলা কমিটির আহ্বায়ক নুর আলম বলেন, ২০ বছর আগে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। এখন আছে মাত্র ১১৪টি। সেখান থেকেও কয়েকটি মারা গেছে। সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার, চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য, বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবন নিরাপদ না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বাঘের সংখ্যা কমেছে। সুন্দরবনের পাশে রামপাল তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পকারখানাসহ সুন্দরবন এলাকার সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।


বাগেরহাট সরকারী পিসি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. শিউলী রাণী সূত্রধর বলেন, সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বাড়ানো জন্য চোরা শিকারি দমন, বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত করা দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মধু সংগ্রহকারী, গোলপাতা সংগ্রহকারী, মাছ শিকারিরা অবাধে সুন্দরবনের গহীনে প্রবেশ করছে। এর ফলে বাঘের সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষ বেড়ে যাচ্ছে। বাঘের শান্তিময় পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। এসব মানুষের জন্য বিকল্প পেশার ব্যবস্থা করছে।


যেসব কারণে বাঘ চলে আসে- শুধুমাত্র বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাঘ লোকালয়ে আসে না। খাদ্য সংকট, সুন্দরবনে অনেক বেশি ঘন গাছ, বনের কোনো কোনো অংশ ফাঁকা হয়ে যাওয়া, বয়স বৃদ্ধির কারণে খাদ্য শিকারে সমস্যার ও প্রজননকালীন সময়েও বাঘ লোকালয়ে চলে আসতে পারে।


সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনা, বয়স ও লিঙ্গ অনুপাতে সুন্দরবনের কম বাঘ সম্পন্ন এলাকায় বাঘ স্থানান্তর, বাঘের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থাপন ও মনিটরিং করা, বাঘের পরজীবীর সংক্রমণ ও অন্যান্য ব্যাধি নির্ণয় ও সুন্দরবনের লোকালয় সংলগ্ন এলাকায় নাইলনের রশির বেষ্টনী তৈরি করা হবে।


তিনি বলেন, বাঘ এবং তার শিকার প্রাণী যাতে নিরাপদে থাকতে পারে এজন্য অভয়ারণ্য বৃদ্ধি করে সুন্দরবনের ৫২ ভাগ এখন অভয়ারন্য করা হয়েছে। লোকালেয়ে আসা বাঘ নিরাপদে বনে ফেরাতেও ব্যাপক জন সচেতনতা তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এর সুফলও পাওয়া গেছে। এখন বাঘসহ বন্য প্রাণী লোকালয়ে এলে স্থানীয়রা বন বিভাগকে অবহিত করে।