প্রশান্তের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক!

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: শনিবার ২৫শে জানুয়ারী ২০২০ ১২:০৬ অপরাহ্ন
প্রশান্তের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক!

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারের অবৈধ সম্পদ সম্পর্কে জানতে তদন্ত চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করে তিনি ভারতে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে।

দেশের একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থেকে বৃহৎ অঙ্কের টাকা লুটে নিয়েছেন প্রশান্ত। বড় বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে দেশের শিল্প বা আর্থিক কোনো খাতে বিনিয়োগও করেননি। এক পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস থেকে তিন হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ার তথ্য পেয়েছে দুদক। অন্য ক্ষেত্রে আরও ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্যও পাওয়া গেছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন। দুদকের অনুসন্ধানে এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে।

প্রশান্তের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। প্রশান্তের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক অডিট প্রতিবেদন সংগ্রহ করেছেন তিনি। পিপলস লিজিং থেকেও পর্যাপ্ত তথ্য ও নথিপত্র সংগ্রহ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পিপলস লিজিং থেকে আরও তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।

গত ৮ জানুয়ারি ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রশান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। এ ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে দেড় হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল। অনুসন্ধানে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। চার্জশিট পেশের জন্য মামলাটির তদন্ত চলছে। তদন্তে তার নামে-বেনামে আরও বড় অঙ্কের অবৈধ সম্পদ পাওয়া যাবে বলে সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন।

দুদকের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশান্তের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা। অবশ্য নিষেধাজ্ঞা জারির আগেই তিনি পালিয়েছেন। আত্মসাৎ করা সব টাকা নিয়েই পালিয়েছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমিয়েছেন বলে শোনা গেলেও তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে।

দুদকের ক্যাসিনোকাণ্ডবিরোধী বিশেষ টিমের তালিকায় প্রশান্তের নাম রয়েছে। এই টিমের সদস্যরাই তার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন।

জানা গেছে, প্রভাবশালী এক শিল্পপতির আশীর্বাদপুষ্ট এই প্রশান্ত এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে এমডির দায়িত্বে ছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের পরিচালক ছিলেন। পিপলস লিজিংয়ের প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায়ও তার হাত ছিল।

দুদক সূত্র জানায়, প্রশান্ত রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি থাকা অবস্থায় প্রভাব খাটিয়ে অন্য লিজিং কোম্পানিতে তার আত্মীয়স্বজনকে স্বাধীন পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করেন। পরে অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে পিপলস লিজিংসহ অন্যান্য লিজিং কোম্পানির অর্থ লুটে নেন। ওইসব কোম্পানির স্থাবর সম্পদ বিক্রি ও আমানতকারীদের শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হয়। ওইসব কোম্পানি এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে।

দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিপলস লিজিংয়ে ২০০৯-১৯ সাল পর্যন্ত এক কোটি বা তার চেয়ে বেশি টাকার ঋণ যাদের দেওয়া হয়েছে, ওইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম এবং তাদের সম্পর্কে তথ্য, ঋণের বর্তমান পোর্টফোলিও, অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট, এসব প্রতিষ্ঠানের ২০১০ সাল থেকে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের অডিট প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নাম ও তাদের সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টও সংগ্রহ করা হয়েছে।

এ ছাড়া ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের আমানতকারীদের কাছ থেকে কত টাকা উত্তোলন করা হয়েছে, কত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, বর্তমানে কত টাকা জমা আছে, প্র্রতিষ্ঠানের নামে কোন ব্যাংকে কত টাকা জমা রয়েছে- এসব তথ্য চেয়ে সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর এমডির কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। প্রশান্তের ব্যাংকিং ও অন্যান্য আর্থিক খাতের দুর্নীতির তথ্য, নথিপত্র চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ মহাব্যবস্থাপকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রশান্ত ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা, প্রশান্তের ব্যক্তিগত হিসাবে ২৪০ কোটি টাকা ও মা লীলাবতী হালদারের হিসাবে জমা হয় ১৬০ কোটি টাকা। ওই হিসাবে বর্তমানে নগদ জমা আছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। আত্মসাৎ করা টাকায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার (মালিকানা) কিনেছিলেন প্রশান্ত। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের টাকার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।

পিপলস লিজিংয়ের তিন পরিচালককে তলব :প্রশান্তের দুর্নীতি অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে পিপলস লিজিংয়ের তিন কর্মকর্তাকে তলব করা হয়েছে। এর পরিচালক ও ভাইস চেয়ারম্যান নিজামুল আহসানকে আগামী ২৭ জানুয়ারি ও কোম্পানির পরিচালক সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও ইউসুফ ইসমাইলকে আগামী ২৮ জানুয়ারি হাজির থাকতে বলা হয়েছে।

এদিকে অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারে অভিযোগ অনুসন্ধান চলাকালে প্রশান্তসহ ২০ জনের সম্পদ, ব্যাংক হিসাব জব্দ ও পাসপোর্ট আটকের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

ইনিউজ ৭১/এম.আর