প্রকাশ: ৩ জুলাই ২০২৫, ১১:২৯
সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাম্প্রতিক প্রস্তাবে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর পদ্ধতি) চালুর প্রস্তাবকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্ক দেখা দিয়েছে। যদিও সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই পিআর পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে ঐকমত্য কমিশন, তবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান একেবারেই ভিন্নমুখী।
বিএনপি ও সমমনা ৬টি দল ও জোট পিআর পদ্ধতির ঘোর বিরোধিতা করছে। তাদের অভিযোগ, এই পদ্ধতির আড়ালে একদিকে নির্বাচন পেছানোর কৌশল নেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ছোট দলগুলোর জন্য সংসদে অতিরিক্ত আসন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করার প্রয়াস চলছে। বিএনপি এই পদ্ধতির কারণে জাতীয় ঐক্য নয় বরং বিভক্তিমূলক সমাজ ও অস্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থার জন্ম হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ উচ্চকক্ষের পাশাপাশি নিম্নকক্ষেও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালুর দাবি জানিয়েছে। তাদের মতে, এই পদ্ধতি চালু হলে প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকবে এবং সব দলই তাদের প্রকৃত জনসমর্থনের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব পাবে। এনসিপি, এবি পার্টিসহ অনেক রাজনৈতিক দল উচ্চকক্ষে অন্তত পিআর পদ্ধতি চালুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তবে তারা নিম্নকক্ষে এই পদ্ধতির বাস্তবতা নিয়ে দ্বিধান্বিত।
ঐকমত্য কমিশনের ২৯ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রস্তাব করা হয়েছে, জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করে নিম্নকক্ষে পূর্বের নিয়মে সরাসরি ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচন বহাল রাখা এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা হবে, যেখানে নারীরা নারীর সঙ্গেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। উচ্চকক্ষে ১০০ জন সদস্য পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে মনোনীত হবেন এবং তারা সাধারণ আইন, সংবিধান সংশোধন, জাতীয় নিরাপত্তা এবং যুদ্ধ ঘোষণা বিষয়ক বিল পর্যালোচনা ও অনুমোদনে ভূমিকা রাখবেন।
তবে এ প্রস্তাবকে বাস্তবতা বিবর্জিত ও রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক আলোচনা সভায় বলেন, “সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থার আড়ালে ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসনের পথ তৈরি হচ্ছে কিনা, তা গুরুত্ব সহকারে ভাবা দরকার।” তিনি এও আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, পিআর পদ্ধতির নামে ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন ইস্যু তৈরি করে দেশকে অস্থির করার চেষ্টা করছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এবং এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনও জানান, উচ্চকক্ষ যদি নিম্নকক্ষের আসনসংখ্যা অনুপাতে গঠিত হয়, তবে তা কার্যত নিম্নকক্ষের প্রতিচ্ছবি হবে এবং উচ্চকক্ষের আলাদা গুরুত্ব হারাবে। তারা মনে করেন, উচ্চকক্ষে যদি প্রকৃত ক্ষমতা না থাকে তবে তার অস্তিত্বেরও প্রয়োজন নেই।
এদিকে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম মনে করেন, পিআর পদ্ধতির কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তা বাস্তবায়ন কঠিন। তিনি বলেন, “পিআর পদ্ধতি চালু হলে ভোটের অপচয় কমে এবং দলগুলোর জবাবদিহিতা বাড়ে। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া এই পদ্ধতি প্রয়োগ সম্ভব নয়।”
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে যে প্রার্থী সর্বোচ্চ ভোট পান তিনিই বিজয়ী হন এবং যেই দল বেশি আসন জেতে তারাই সরকার গঠন করে। কিন্তু প্রস্তাবিত সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে প্রতিটি দল তার মোট ভোটের অনুপাতে আসন পাবে। ফলে ছোট দলগুলোর জন্য সংসদে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হবে, তবে এতে বড় দলগুলো তাদের প্রভাব হারাবে বলে আশঙ্কা করছে বিরোধীপক্ষ।
এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতবিরোধ নিরসন না হলে পিআর পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে আসন্ন নির্বাচনী ব্যবস্থায় আরও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো এখন সময়ের দাবি।