ফাইলবন্দি এসিটি শিক্ষকদের ভাগ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: রবিবার ৩০শে জুন ২০১৯ ০৫:১০ অপরাহ্ন
ফাইলবন্দি এসিটি শিক্ষকদের ভাগ্য

সরকার যখন শিক্ষার মানোন্নয়নে দেশের বাইরে থেকে শিক্ষক আনার কথা ভাবছে তখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কয়েক হাজার প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ভাগ্য ঝুলে আছে শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের রেষারেষিতে। সেকায়েপ প্রকল্পের আওতায় নিয়োগ পাওয়া এসব শিক্ষক ভালো ফলাফল করাতে বিশেষ ভূমিকা রাখলেও তাদের চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। শিক্ষাবিদরাও বলছেন, ভালো শিক্ষক হিসেবে যারা এরই মধ্যে নিজেদের প্রমাণ করেছেন, তাদের অবজ্ঞা করে বাইরের শিক্ষক আনার ঘোষণায় সরকারের অবস্থান নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাধ্যমিক স্তরে দেশের পিছিয়ে পড়া ২১০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেকায়েপ প্রকল্পের আওতায় নিয়োগ পাওয়া অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষকরা (এসিটি) ইংরেজি, গণিত এবং বিজ্ঞান বিষয়ের মানোন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এমনকি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় এসব শিক্ষকদের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। এসব শিক্ষকদের চেষ্টায় সার্বিক ফলাফলেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু বিগত দেড় বছরেও তাদের অন্য প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত না করা বা এমপিওভুক্তি না করায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবারও ফল খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন ওইসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। এসব শিক্ষকরা চাকরি স্থায়ীকরণের নিশ্চয়তা না পেলে অন্যত্র চলে যেতে পারেন- এই আশঙ্কায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের উদ্যোগে অনেক শিক্ষককে নিজেদের সাধ্যমতো সম্মানী প্রদান করার চেষ্টা করছেন। 

তবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি বলছে, এভাবে ধারকর্জ করা টাকা দিয়ে তাদের পক্ষে বেশিদিন এসব শিক্ষককে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। অচিরেই তারা এ বিষয়ে সরকারের কাছে সমাধান দাবি করেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগ স্থায়ী হতে বিলম্বিত হওয়ায় শিক্ষার মান বাড়াতে সরকারের অঙ্গিকার বাস্তবায়নের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।

২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর এসব শিক্ষকদের কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাদের ক্লাস নেয়া অব্যাহত রাখতে নির্দেশ দেন। তিনি এসব শিক্ষকদের অন্য প্রকল্পে স্থানান্তরের কথা জানান। তবে সাম্প্রতিক সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসব শিক্ষকদের নতুন প্রকল্পে স্থানান্তরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে টাকা চাওয়া হলেও তা দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা চান এই শিক্ষকদের একটি স্থায়ী সমাধান। অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর করলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। বরং কয়েক বছর পর এসব শিক্ষক আবারও বেতনহীন হয়ে পড়বেন। ফলে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব শিক্ষকদের বিষয়ে স্থায়ী সমাধানের প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, সেটি করতে গেলে 'বিধিগত' জটিলতায় পড়তে হতে পারে। দুই মন্ত্রণালয়ের এমন বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে এসিটি শিক্ষকরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক এসিটি শিক্ষক এরই মধ্যে ক্লাস নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। যার ফলাফল সরাসরি শিক্ষার মানের ওপর পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে এসিটি শিক্ষকরা দাবি করছেন, তাদের নিয়োগ দেয়ার সময় স্থায়ী করার অঙ্গিকারও ছিল সরকারের। কিন্তু সরকার তা না করে প্রায় ছয় হাজার তরুণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে ক্ষোভ জানিয়েছেন তারা। এখন সরকার বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার কথা বললেও দেশের ভেতরে যেসব শিক্ষক মানোন্নয়নে এরই মধ্যে অবদান রেখেছে, তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ তাদের। এসব শিক্ষকের কাজ দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এ ধরনের আরও এসিটি শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার কথা বলেছিলেন এবং সেকায়েপ প্রকল্পের প্রধান অর্থ সংস্থান প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক থেকেও এসব শিক্ষকদের বিষয়ে একাধিকবার প্রশংসা করে তাদের স্থায়ী করার সুপারিশ করা হয়েছে। এরপরও কেনো এসব শিক্ষকের চাকরি এমপিভুক্ত বা জাতীয়করণের মাধ্যমে স্থায়ী করা নিয়ে জটিলতা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এসব শিক্ষকরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ এসিটি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কৌশিক চন্দ্র বর্মণ বলেন, 'আমাদের নিয়োগ দেয়ার সময় স্থায়ী করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উলেস্নখ করা হয়েছিল। ফলে আমরাও আর অন্য কোনো চাকরিতে চেষ্টা না করে শিক্ষার্থীদের শেখানোর জন্য নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দেই। এ ছাড়া আমাদের জানানো হয়েছিল, শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের যে অঙ্গিকার, এর অংশ হিসেবেই আমাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফলে আমরাও বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আমাদের ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল স্যারও আমাদের সঙ্গে যতবার দেখা করেছেন, ততবারই তিনি আমাদের জানিয়েছেন এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় সবকিছু করবে। কিন্তু এরপরও বিগত দেড় বছরে বিষয়টির কোনো সমাধান হয়নি। আমরা এখন খুবই অমানবিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে দিনাতিপাত করছি। শুনেছি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় অন্য এক প্রকল্পে স্থানান্তরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অর্থ চেয়েছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকল্পে স্থানান্তর না করে স্থয়ী সমাধান চেয়েছে। যেখানে বিধিগত জটিলতার কারণে বিষয়টি আটকে আছে। আমরা মনে করি, সরকারের দুটি মন্ত্রণালয় আন্তরিকভাবে চাইলে বিধিগত জটিলতা দূর করা মোটেও জটিল নয়। সরকার দ্রম্নত একটি সমাধান করবে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা।'

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে কিছুদিন আগে এসিটি শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব জাভেদ আহমেদ জানিয়েছিলেন, 'বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ইতিবাচক সাড়া দিলে দ্রম্নততম সময় বিষয়টির একটি সুরাহা হবে।' অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুর রউফ তালুকদার জানিয়েছেন, তারা এ বিষয়ে একটি স্থায়ী সমাধান চান। অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর করলে কয়েক বছর পর এসব শিক্ষকরা আবারও বেতনহীন হয়ে পড়বে। এ কারণে তারা এমপিওভুক্তি বা অন্য কোনো উপায়ে স্থায়ী করার বিষয় নিয়ে ভাবছেন। 

উলেস্নখ্য, ২০১৫ সালে সেকায়েপ প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলার সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে (২১০০ প্রতিষ্ঠান) ৫২০০ শিক্ষক নিয়োগ করে সরকার। উদ্দেশ্য ছিল, এসব প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি, গণিত এবং বিজ্ঞান বিষয়ে এসব শিক্ষকরা অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার মাধ্যমে মানোন্নয়ন করা। প্রতিবছরই দেখা যায়, খারাপ ফলাফলের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে এই তিনটি বিষয়। এসব শিক্ষক নিয়োগের ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানে অকৃতকার্যের সংখ্যা উলেস্নখযোগ্য হারে কমে যায় এবং মানোন্নয়ন ঘটে কঠিন এ বিষয়গুলোর ফলাফলে। যা পুরো দেশের রেজাল্টে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। দুই বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসব শিক্ষকদের ক্লাস নেয়া অব্যাহত রাখতে বলা হয় এবং জানানো হয়, তাদের স্থায়ী করা হবে। কিন্তু সেই আশ্বাসের পর প্রায় দেড় বছর পার হলেও শিক্ষকদের এখনো স্থায়ী করেনি সরকার।

ইনিউজ ৭১/এম.আর