পেঁজার দিয়ে যেভাবে হিজবুল্লাকে বোকা বানিয়ে হত্যা করলো ইসরাইল। বিশ্লেষণ ...

নিজস্ব প্রতিবেদক
মোঃ শওকত হায়দার (জিকো) সম্পাদক , ইনিউজ৭১
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ১৭ই অক্টোবর ২০২৪ ০৫:৩১ অপরাহ্ন
পেঁজার দিয়ে যেভাবে হিজবুল্লাকে বোকা বানিয়ে হত্যা করলো ইসরাইল। বিশ্লেষণ ...

ইসরাইলের জন্মলগ্ন থেকেই মধ্য প্রাচ্য জুড়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম শক্তিশালী ভাবে পরিচালিত হয়। সেই আলোকেই লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণাংশের শহরতলীতে গত সেপ্টেম্বরের এক সন্ত্রাসী হামলায় ১২ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এই ঘটনায় অভিযুক্ত প্রধান আসামী হিসেবে ইসরাইলের নাম উঠে এসেছে। হিজবুল্লাহ এবং লেবানিজ সরকার উভয়েই এই হামলার দায় ইসরাইলের উপর চাপিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিস্ফোরণটি হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে পরিচালিত একটি নিখুঁত পরিকল্পনার অংশ।


১৭ সেপ্টেম্বরের ওই হামলায়, হাজার হাজার হিজবুল্লাহ সদস্যের জন্য যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত পেজারগুলোতে একই সাথে সঙ্কেত পাঠানো হয়। এর ফলে একযোগে বিস্ফোরণ ঘটে, যা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আশেপাশে থাকা লোকজনকেও আহত করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে, দূর থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।


আমরা জেনেছি রয়টার্সের প্রতিবেদনের মাধ্যমে , এই পেজারগুলো ইসরাইলিদের নজরদারি এড়াতে চলতি বছরের শুরুতে হিজবুল্লাহ ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। কিন্তু নিরাপদ মনে করে ব্যবহৃত এই পেজারগুলোই তাদের জন্য মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়। পেজারগুলোর মাধ্যমে ইসরাইল হিজবুল্লাহর সদস্যদের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করে। 


ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ এক বছর ধরে কাজ করেছে। তারা প্রথমে ভুয়া অনলাইন স্টোরের মাধ্যমে পেজারগুলো বিক্রি করতে শুরু করে। এমনকি পেজার বিক্রির জন্য তৈরি করা ওয়েবসাইটগুলোতে নিয়মিত পোস্ট দেওয়া হয়, যা হিজবুল্লাহর সদস্যদের আকৃষ্ট করে।


বহু বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন, পেজারগুলোতে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের ব্যাটারি সেগুলোকে বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। ব্যাটারি সেলে লুকানো একটি শক্তিশালী প্লাস্টিক বিস্ফোরক ছিল, যা সঠিক সময়ে সক্রিয় হওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। হামলার পর, পেজারগুলো তৈরির জন্য দায়ী কোম্পানি হিসেবে তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলোর নাম সামনে আসে। যদিও কোম্পানির প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, তারা এই হামলায় জড়িত নয়।


অন্যদিকে, রয়টার্স যে বিশ্লেষণ করেছে তাতে দেখা গেছে, গোল্ড অ্যাপোলোর তৈরি পেজারগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য বিস্ফোরিত পেজারগুলোর সঙ্গে মিল রয়েছে। সুতরাং, হামলার পেছনে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিস্ফোরণের সময় এই পেজারগুলো নিরাপত্তা স্ক্যানার পেরিয়ে গেছে, যেহেতু এগুলো ডিজাইন করা হয়েছিল যাতে তা শনাক্ত না হয়।


বিস্ফোরণের ফলে আহতদের মধ্যে অনেকের চোখে আঘাত, আঙুল বিচ্ছিন্ন বা পেটে ছিদ্র ছিল। হামলার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে। তবে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ট মোসাদের প্রশংসা করেছেন।


এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, হিজবুল্লাহর জন্য যা ছিল একটি নিরাপদ যোগাযোগের মাধ্যম, সেটিই তাদের জন্য মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলের এই কৌশলগত হামলা যে কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা অপারেশনের অংশ, তা আর অজানা নয়।


হিজবুল্লাহর পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের পর, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা এই অভিযানের বিষয়ে আগে থেকে জানতেন না। এই ঘটনা লেবাননের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে এবং ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা বাড়াতে পারে।


সর্বশেষ, লেবাননের তথ্য মন্ত্রণালয় ও হিজবুল্লাহর মুখপাত্র এই বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। তবে স্পষ্ট যে, এই বিস্ফোরণের ঘটনা শুধুমাত্র একটি সন্ত্রাসী হামলা নয়, বরং এটি একটি নতুন ধরনের যুদ্ধের সূচনা। ইসরাইলের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ ব্যবস্থা যে কতটা কার্যকর, সেটিই হয়তো আগামীদিনগুলোতে প্রমাণিত হবে।