প্রিন্ট কারখানায় ৮ হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন স্বপন মিয়া। এ দিয়ে কোনো মতো চলত পাঁচ সদস্যের সংসার। এরই মধ্যে প্রিন্ট কারখানার কাজটাও চলে যায়। সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। তাইতো অভাবের তাড়নায় সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া নাড়িছেঁড়া ধনকে বুকে আগলে রাখতে পারেননি একদিনও। তাই আরেক নিঃসন্তান দম্পতিকে দত্তক দিয়েছেন স্বপন-হালিমা দম্পতি।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার গোলাকান্দাইলের মাহনা এলাকায় আম্বিয়া হকের বাড়িতে ভাড়ায় থাকেন স্বপন-হালিমা দম্পতি। ৮ বছর আগে প্রণয় থেকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। পরিবার মেনে না নেওয়ায় ঘরছাড়া স্বপন মিয়া কখনো রিকশা চালিয়েছেন, কখনো দিনমজুরের কাজ করেছেন আবার প্রিন্ট কারখানায়ও কাজ করেছেন। তবে সংসারের অভাব মোচন করতে পারেননি। নিজেরা না খেয়ে বাচ্চাদের চিড়া আর গুড় দিয়ে কোনো মতো দিন পার করিয়েছেন। এর মাঝে তাদের ঘরে আসে চতুর্থ সন্তান।
বড় সন্তান সাদিয়া আক্তারের বয়স সাড়ে ৬ বছর। এরপর মো. সানী মিয়ার বয়স সাড়ে ৪ বছর ও সাড়ে তিন বছরের মোস্তাকিম নামে আরেক সন্তান রয়েছে এই দম্পতির। তবে চতুর্থ সন্তানকে লালন-পালনের সামর্থ্য না থাকায় সাভারের এক নিঃসন্তান দম্পতিকে দত্তক দিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২ আগস্ট (শুক্রবার) রাত ২টায় প্রচণ্ড প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছিলেন হালিমা আক্তার (২১)। রাত ৩টায় স্বাভবিকভাবে হালিমা একটি কন্যাশিশু প্রসব করেন। এমন পরিস্থিতিতে হালিমার স্বামী স্বপন মিয়া ভোরে স্থানীয় স্মৃতি নামে এক প্রতিবেশীকে ডেকে শিশুর নাড়ি কাটেন। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন হালিমা। যেখানে ‘নুন আনতে পান্তা ফুড়ায়’ অবস্থা তাদের, সেখানে হাসপাতালে যাওয়ার পয়সা না থাকায় বাড়িতেই পড়ে থাকেন হালিমা। পরে খবর পেয়ে স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক দায়িত্ব নিয়ে রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়া হালিমা আক্তার বলেন, এতদিন পেটে ধরে কেউ কি নিজের বাচ্চাকে দিয়ে দেয়? আমার স্বামীর কোনো কাজকর্ম নাই, চলতে কষ্ট হয়। আমাদের আর্থিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ, তাই দিয়া দিসি। শুক্রবার রাতে জন্ম নিছে আর শনিবার বিকেল ৩টায় দিয়ে দিছি। শরীর খুব দুর্বল হয়ে গেছে, হাঁটতে পারছি না একেবারেই। সারা শরীরে ব্যথা, পেটে ও মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এখানে আসার পর কিছুটা আরাম পাচ্ছি। খাবার থেকে শুরু করে ওষুধ যা লাগছে হাসপাতাল থেকে দিচ্ছে।
হালিমার স্বামী স্বপন মিয়া বলেন, যে বেতনে কাজ করতাম, সেই টাকা দিয়ে কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেছি। আমার গর্ভবতী স্ত্রীকে কখনো ভালো কোনো খাবার কিনে খাওয়াতে পারিনি। চার মাসের ঘর ভাড়া জমে গেছে। ৮ হাজার টাকা বেতনে একটা প্রিন্ট কারখানায় কাজ করতাম, কারখানায় কাজ না থাকায় সেখান থেকে চলে আসি। এরপর রাস্তায় রাস্তায় কাজের জন্য ঘুরেছি, কত রিকশার গ্যারেজে গিয়েছি। কিন্তু জামিনদার না পাওয়ায় সেই রিকশারও ব্যবস্থা হয়নি। সারা দিন রাস্তায় ঘুরে ঘরে গিয়ে নিজ বউয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না লজ্জায়। বাচ্চারা ১০ টাকা চাইলেও দিতে পারি না, খুব কষ্ট লাগে।
তিনি বলেন, যে টাকা রোজগার করি, সেই টাকা দিয়ে নিজেরাই চলতে পারি না। দিনে একবেলা খাবার জোটে না। সব বাবা-মায়ের আশা থাকে সন্তানকে ব্যারিস্টার কিংবা ডাক্তার বানানোর। আমারও স্বপ্ন ছিল। তবে মানবেতর জীবন-যাপনের কারণে তিন সন্তানকে স্কুল কিংবা মাদরাসায় পড়াতে পারছি না। তাই হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিই সদ্য ভূমিষ্ট সন্তানকে পালক দিয়ে দেওয়ার। শুক্রবার রাতে সন্তান পৃথিবীতে আসে আর পরের দিন দুপুরে তাকে সাভারের আকরাম হোসেন নামে এক গার্মেন্টকর্মীর কাছে পালক দিয়েছি। চাইলে লাখ টাকাও চাওয়া যায়, কিন্তু এইটা তো গরু-ছাগল না যে বিক্রি করে দেবো। আমার তো সামর্থ্য নাই, তাই আরেকজনকে দিয়ে দিসি, যেন মানুষ হতে পারে।
সন্তানকে দিয়ে দিলেন, কষ্ট হয় না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অভাবের জন্য নিজের সন্তানকে দিয়ে দিয়েছি, এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে। কিন্তু এখন যেহেতু দিয়ে দিয়েছি আর কী করার আছে, তবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি দত্তক নেওয়া আক্তার হোসেন দম্পতি ও আমার সন্তান ভালো আছে, সুখে আছে।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রসূতি বিভাগে দায়িত্বরত এক নার্স জানান, হালিমার ঘটনা খুবই হৃদয়বিদারক। এটা আসলেই কষ্টের কথা। এক দিন কিংবা দুই দিন নয়, পুরো ১০ মাস ১০ দিন গর্ভেধারণ করে জন্ম দেওয়া সন্তানকে দিয়ে দেওয়া অনেক কষ্টের বিষয়। এই কষ্ট মা ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারে না। স্বামীর আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কারণেই বাচ্চাকে দত্তক দিয়েছে। একজন মা বরাবরই নিজের জীবর দিয়ে সন্তানকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। অভাবের কারণে নিজের সন্তানকে দিয়ে দেওয়ার মতো কষ্টের কিছু হতে পারে না।
তিনি বলেন, হাসপাতালের আরএমও, টিএসও, ডাক্তার ও আমরা আমাদের জায়গা থেকে যথেষ্ট চেষ্টা করছি তাকে সুস্থ করে তুলতে। মানসিক দিক থেকে ও শারীরিক দিক থেকে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তিনি যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন এই কামনা করি।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার মোশারফ হোসেন বলেন, হালিমা নামে একজন রোগী প্রসব পরবর্তী জটিলতা নিয়ে সোমবার হাসপাতালে আসেন। তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শুক্রবার রাতে তার নরমাল ডেলিভারি হয়। তাকে দেখে যেটা মনে হয়েছে, তিনি পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। হাসপাতাল থেকে তাকে ডাবল ডায়েট দেওয়া হচ্ছে এবং সব রকমের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সিভিল সার্জন ডা. এএফএম মুশিউর রহমান ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আরিফ ফেরদৌসের তত্ত্বাবধানে তার যাবতীয় ওষুধপত্র থেকে শুরু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সবই করা হচ্ছে হাসপাতাল থেকেই।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।