করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে সাপ, ইঁদুর খাওয়ার অভ্যাস থেকেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ২৩শে জানুয়ারী ২০২০ ০৯:০২ অপরাহ্ন
করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে সাপ, ইঁদুর খাওয়ার অভ্যাস থেকেই

বিশ্বে নতুন আতঙ্ক এখন করোনা ভাইরাস। এর সংক্রমণ হলে জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, শ্বাসের হার বেড়ে যাওয়া বা গলায় ঘা দেখা দেয়। সার্সের মতো এ-ও প্রাণঘাতী হতে পারে।করোনা ভাইরাস চীনের হুবেই রাজ্যের উহান শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রথম ছড়িয়ে পড়ে। ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত চীনে ৫৫৫ জন আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। এদের মাঝে ৪৪৪ জন রোগী উহান শহরের, ২৬ জন গুয়াংডং প্রদেশের, ১৪ জন বেইজিং শহরের এবং ৯ জন সাংহাই শহরের বাসিন্দা।

বাদুড়কে এর উৎস বলে চিহ্নিত করা হয়। আবার গবেষকরা বর্তমানে ধারণা করছেন, চীনা ক্রেইট ও চীনা কোবরা সাপ থেকেই চীনে নতুন আবিষ্কৃত করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে। সঙ্গে স্পষ্ট হয়, চীনাদের যে কোনও পশু-পাখির মাংস খাওয়ার অভ্যাসই এর মূলে। এ বারেও সংক্রমণ ছড়িয়েছে ‘হুয়ানান সিফুড মার্কেট’ থেকে। যেখানে অনলাইনে অর্ডার করলেই ঘরে পৌঁছে যায় শেয়াল, কুমির, নেকড়ে ছানা, বড় স্যালামান্ডার, সাপ, ইঁদুর, ময়ূর, শজারু, উট— মোট ১১২ ধরনের প্রাণীর মাংস। চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের ডিরেক্টর গাও ফু বলেছেন, ‘ওই বাজারের বুনো পশুর মাংস থেকেই রোগটা ছড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।’ মার্কিন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সোসাইটির কর্মকর্তা সি ওয়ালজারের কথায়, ‘সংক্রামক যত নতুন রোগ দেখা যাচ্ছে, তার ৭০% আসছে বন্যপ্রাণী থেকে। তাদের মাংস থেকে। কিংবা তাদের বসবাসের জমি কেড়ে নেয়ায়।’

করোনা ভাইরাস বলতে এক গোত্রের অনেকগুলি ভাইরাসকে বোঝায়। বার্ড ফ্লু তথা সার্সের ভাইরাসও এই গোত্রের। ২০০২-এর নভেম্বর থেকে আট মাসে চীন, হংকং, কানাজা-সহ বিভিন্ন দেশ মিলিয়ে ৭৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ভারতেও প্রবল আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বিশেষ করে কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গে। সেই সূত্রে বাংলাদেশেও এটি ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে। চীন থেকে এ ভাইরাস ইতোমধ্যে নানাভাবে দ্রুত তাইওয়ান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। এছাড়াও চীনের উহান থেকে ম্যাকাও যাওয়া এক ব্যক্তির শরীরেও এই ভাইরাসজনিত রোগ পাওয়া গেছে।

এই করোনা ভাইরাস সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম করোনা ভাইরাস বা সার্স এবং মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম করোনা ভাইরাস বা মার্স এর পরিবারভুক্ত ভাইরাসের অনুরূপ। এই দুটি ভাইরাস গত ১৭ বছর ধরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে চলে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নতুন এই করোনা ভাইরাসকে '২০১৯-এন করোনা ভাইরাস নাম দিয়েছে।করোনা ভাইরাস নামটি এসেছে এর আকৃতির ওপর ভিত্তি করে। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে ক্রাউন বা মুকুটের মতো দেখতে হওয়ায় এর নাম হয়েছে করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখিতে প্রাথমিক অবস্থায় শ্বাসনালীর উপরের দিকে ও পরিপাকতন্ত্রের নালিতে সংক্রমণ ঘটায়। যদিও অধিকাংশ করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে হালকা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো উপসর্গ প্রকাশ পায় কিন্তু সার্স ও মার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে মানুষের শ্বাসনালীতে সংক্রমণ প্রকাশ পায়। এছাড়াও নানা ধরনের জটিলতাও দেখা দেয়।

নতুন ‘২০১৯-এন করোনা ভাইরাস’ দ্বারা আক্রান্ত হলেও সার্স এবং মার্স ভাইরাসের মতো উপসর্গ প্রকাশ পায়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষের শ্বাসনালী তীব্র সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো এর কোনো প্রতিষেধক টিকা ও চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি।যেহেতু প্রতিষেধক টিকা ও চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি তাই রোগ প্রতিরোধে এই ভাইরাসের উৎস, রোগ বিস্তারের উপায়, পুনরুৎপাদন পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হবে। ‘জার্নাল অব মেডিকেল ভাইরোলজি’তে প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় নতুন করোনা ভাইরাস সার্স ও মার্স ভাইরাসের খুবই নিকট বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তাই গবেষকরা প্রথমে ধরে নিয়েছিলেন এটি বাদুড় থেকেই ছড়িয়েছে ও পরে পরিবর্তিত হয়ে মানুষকে সংক্রমিত করছে। কিন্তু যখন গবেষকরা বিস্তারিত তথ্য বিশ্লেষণ করেন তখন বলেন, সম্ভবত নতুন ‘২০১৯-এন করোনা ভাইরাস’ সাপ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। এর ফলে সিফুডের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছিল বলে কথাটি বন্ধ হয়ে যায়।

করোনা ভাইরাস পাওয়া যায় এমন সকল প্রাণী নিয়ে গবেষকরা প্রোটিন কোড বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তারা সাপের ক্ষেত্রে নতুন করোনা ভাইরাসের প্রোটিন কোডের মিল খুঁজে পান। চীনে প্রচুর ডোরাকাটা ক্রেইট সাপ রয়েছে। সাপ মূলত বাদুড় শিকার করে। এই সাপ আবার উহানের স্থানীয় সিফুড মার্কেটে বিক্রি হয়। সেখান থেকেই নতুন করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।বাদুড় থেকে সাপের মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়েছে বলা হলেও শীতল ও উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণীতে এই ভাইরাস কীভাবে বসবাস করছে তা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে। তবে বন্য জীবজন্তু শিকার করে খাওয়া যে উচিত নয় এই নতুন করোনা ভাইরাস আবারও বিশ্ববাসী তথা চীনের অধিবাসীদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। সূত্র: সিএনএন।