ইউক্রেন পরিস্থিতি: ‘আর কি দেখা হবে আমাদের?’

নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: শুক্রবার ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:১৫ অপরাহ্ন
ইউক্রেন পরিস্থিতি: ‘আর কি দেখা হবে আমাদের?’

মাত্র দুই দিন আগেও ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ওদের জীবনটা চলছিল স্বাভাবিকভাবেই। যুদ্ধ যুদ্ধ শুনলেও তারা ভেবেছিল হয়তো শেষ রক্ষা হবে। তবে শেষ রক্ষা হলো না। বেধে গেল যুদ্ধ। চরম আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে কিয়েভবাসীর। তাদেরই কয়েকজন জানিয়েছে নিজেদের যুদ্ধদিনের গল্প।


ঘুম ঘুম চোখে শুনলেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে

যুদ্ধ শুরু হতে পারে—এই আশঙ্কা নিয়ে গল্প করতে করতে গত বুধবার রাতে ঘুমাতে যেতে অনেক দেরি হয়েছে ইউলিয়া  তিমোশেঙ্কোর। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের বাসিন্দা ২২ বছর বয়সী ইউলিয়া কেবল ঘুম আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক বন্ধুর খুদে বার্তা—‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে’ পেয়ে ঘুম ঘুম চোখে কী করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। প্রথমে ভেবেছিলেন, এটা ভুল তথ্য। পরক্ষণেই ভুল ভাঙে বিকট বিস্ফোরণের শব্দে। চারদিকে আতঙ্কিত মানুষের শোরগোল আর চিৎকারে অস্থির পুরো শহর। মাথার ওপর বোমারু বিমানের শব্দ। ঠিক, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এখন কী পালাতে হবে! কোথায় পালাব, কীভাবে পালাব—এই ভাবনায় অস্থির সময় কেটেছে ইউলিয়ার। এখনো নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজে পাননি তিনি। 


রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী-নিয়ন্ত্রিত দনবাসে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশের পরই রাশিয়ার সীমান্তের দক্ষিণের খারকিভে স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে বিস্ফোরণ ঘটে। ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এটি। শহরটি রাশিয়া সীমান্তের ৩৫ কিলোমিটার (২০ মাইল) দক্ষিণে। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের এই এলাকায় ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী ও মস্কো-সমর্থিত বিদ্রোহীদের লড়াই চলছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে ইউক্রেনে সামরিক শাসন জারির আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।


এবিসি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ইউলিয়া তিমোশেঙ্কো গত কয়েক মাস থেকে কিয়েভে থাকছেন। সেদিন ঘুমাতে যাওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর ঘুম ভেঙে যায়।


ইউলিয়া জানান, ‘ঘুম থেকে উঠেই মাথার ওপর সামরিক বিমান ওড়ার শব্দ শুনছি। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সামরিক আইন জারির ঘোষণা দিয়েছেন। বিমান হামলার সাইরেন বাজছে। বাইরে-পথে হাজারো মানুষের চিৎকার। ঘুম ভেঙেই একটা ভয়ংকর অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি।’


শুরুতেই পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিয়েছেন ইউলিয়া। পালানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কিয়েভের রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে যায়। কোথাও যাওয়ার মতো সড়কে কোনো গাড়ি নেই। এক বন্ধুকে ট্রেনের টিকিট কিনতে বলেছিলেন, কিন্তু কোথাও যাওয়ার কোনো টিকিট নেই। স্টেশনে লাখো মানুষের ভিড়। বাইরে থেকে পরিচিতজনেরা জানিয়েছেন—এমন পরিস্থিতিতে রাস্তায় বের হওয়া বিপজ্জনক হবে।


এবিসি নিউজকে ফোনে ইউলিয়া জানিয়েছেন, ‘আমি এখনো ঘরবন্দী। কোথাও যেতে পারিনি। জীবনে কী হবে জানি না। তাই পরিচিতজনদের সঙ্গে শেষ কথা বলে নিচ্ছি। বলছি, আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি।’


‘আমরা বুড়ো মানুষ, কী করব এই পরিস্থিতিতে?’

৭৩ বছর বয়সী গালিনা একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। ৭৫ বছরের বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে থাকেন সেন্ট্রাল কিয়েভে। গালিনা নিউইয়র্ক পোস্টকে ফোনে যুদ্ধাবস্থায় নিজেদের দুর্দশার ভয়াবহ বিবরণ দিয়েছেন। রাশিয়ার সেনার ভয়ে তাঁরা নিজেদের পুরো নাম প্রকাশ করেননি।


গালিনা বলেন, ‘কিয়েভে এখন সবকিছু বন্ধ। রাস্তাঘাট খাঁ খাঁ করছে। আমরা কোথাও যেতে পারিনি। আর কোথায় পালিয়ে যাওয়ার ঝক্কি নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থাও আমাদের নেই। আমরা ঘরবন্দী। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কাছে কেবল দুই দিনের খাবার আছে। এরপর কী হবে জানি না।’


গালিনা বলেন, বিস্ফোরণের শব্দ হওয়ার পরপরই লাখো মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। যে যা পেরেছে, তা–ই নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে গেছে। রাস্তায় সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। কিন্তু আমরা বুড়ো মানুষ, কী করব এই পরিস্থিতিতে? যুদ্ধের আগে বিশ্বনেতারা বড় বড় কথা বলেছেন। এখন তাঁরা সবাই চুপ। তাঁরা আসলে সবাই মিথ্যাবাদী।’


নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৪০ বছর বয়সী আরেকজন বলেছেন, যেকোনো সময় বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। তাই তিনি প্রাণ বাঁচাতে পোল্যান্ড সীমান্তে পালিয়ে গেছেন। সীমান্তেও লাখো মানুষের সারি। হয়তো তাঁদের অনেকেরই এখন আশ্রয় হবে পোল্যান্ডে।


১৫ বছর বয়সী কিশোরী ড্যানিয়েল। সে পরিবারের সঙ্গে কিয়েভে থাকে। বৃহস্পতিবার ভোরে বিস্ফোরণের শব্দে তার ঘুম ভেঙেছে। এই যুদ্ধ পরিস্থিতির বিবরণ টুইটারে সিএসবি নিউজকে জানিয়েছে ড্যানিয়েল।


ড্যানিয়েল জানায়, ‘ভোর পাঁচটার দিকে বিস্ফোরণের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আতশবাজির শব্দ ভেবে আমার ঘুমিয়ে পড়ি। সকাল সাতটার দিকে অন্য শহর থেকে এক বন্ধু খুদে বার্তায় জানিয়েছে, সেও বিকট শব্দ শুনেছে। সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। পরে খবরে জানা গেল, রাশিয়া ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। মানে যুদ্ধ লেগে গেছে।’ এর কিছুক্ষণ পরই ড্যানিয়েলের বাসার কাছেই বিস্ফোরণের শব্দ হয়েছে। তবে এখন তারা ঠিক আছে।


খারকিভ থেকে ড্যানিয়েলকে তার বন্ধু ভয়াবহ পরিস্থিতি জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠাচ্ছে। সে জানিয়েছে, খারকিভের সড়কে এখন মানুষ নেই। কেবল ইউক্রেনের অসংখ্য ট্যাংক ও সেনাসদস্য আছে।


নিজের চোখে কান্না রেখে স্টেশনে আশ্রয় নেওয়া এক মা সন্তানকে হাসানোর চেষ্টা করছেন। 

নিজের চোখে কান্না রেখে স্টেশনে আশ্রয় নেওয়া এক মা সন্তানকে হাসানোর চেষ্টা করছেন। ছবি: এএফপি

সিএসবি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটু সুযোগ পেলেই ড্যানিয়েল ও তার পরিবার নিরাপদ কোনো স্থানে চলে যাবে। কিন্তু ড্যানিয়েল এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে চায় না, মৃত্যু দেখতে চায় না। সে চায় শান্তি ফিরে আসুক। স্কুল খুলে যাক।


বৃহস্পতিবার বিস্ফোরণের ঘটনার পর পরই কিয়েভ থেকে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি শুরু করে। যে যেভাবে পারছে ছুটছে। কেউ গাড়িতে, কেউ হেঁটে আর কেউবা দিনিপ্রো নদী পেরিয়ে যাচ্ছে। দিনিপ্রো নদী পাড়ি দেওয়ার আগে একটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি। তিনি বলেছেন, হাতের কাছে যে যা পেয়েছে, তাই নিয়েই বাঁচার আশায় ছুটছে মানুষ।


ইউক্রেনের উত্তরের শহর চেরনিহিভের বাসিন্দা অ্যানার সঙ্গে কথা হয় তাঁর। দুটি গাড়ির একটিতে কিছু মালামাল, আরেকটিতে স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে দিনিপ্রো নদী পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। পথে যানজটে আটকা পড়েছেন। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে অ্যানা বলেন, ‘আমার কিচ্ছু করার নেই। বাচ্চাদের বাঁচাতে হবে। তাই পালিয়ে যাচ্ছি। হয়তো স্বজনদের সঙ্গে আর দেখা হবে না।’


ভাষান্তর: সুজন সুপান্থ