বাংলা কম্পিউটিংয়ের জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করা অভ্র কীবোর্ডের উদ্ভাবক ডা. মেহেদী হাসান খান ২০২৫ সালের একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন। বাংলা ভাষার ডিজিটাল প্রসারে তার অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সরকার এই পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দীর্ঘ দুই দশকের সংগ্রামের পর তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছেন, যদিও এই পথ ছিল সহজ নয়। অভ্র কীবোর্ডের মাধ্যমে বিনামূল্যে ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা টাইপিংয়ের সুবিধা সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়, যা একচেটিয়া বাণিজ্যিক বাধা ভেঙে সাধারণ মানুষের কাছে বাংলা লেখাকে সহজলভ্য করেছে। তবে এই অর্জনের পেছনে বহু ষড়যন্ত্র ও বাধা পেরোতে হয়েছে তাকে, বিশেষ করে বিজয় কীবোর্ডের মালিক মোস্তাফা জব্বারের সাথে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব এবং সরকারে থাকা কিছু মহলের বিরোধিতার কারণে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এতদিন আসেনি
মেহেদী হাসান খান ১৯৮৬ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক, নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং পরে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। কলেজে পড়ার সময় তিনি বাংলা কম্পিউটিং সহজ করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ অভ্র কীবোর্ডের প্রথম সংস্করণ তৈরি করেন, যা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অভ্রর মাধ্যমে বাংলা টাইপিং সহজ হয়ে যায়, যা আগে কেবল বিজয় কীবোর্ডের মতো বাণিজ্যিক সফটওয়্যার ব্যবহারকারীদের জন্য সীমিত ছিল। মেহেদী হাসান তার সফটওয়্যারটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন, যা বাংলা ভাষার জন্য এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়
অভ্রর সাফল্য সত্ত্বেও এর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র হতে থাকে। বিশেষ করে বিজয় কীবোর্ডের মালিক মোস্তাফা জব্বার অভ্রর বিরুদ্ধে পাইরেসির অভিযোগ আনেন এবং এটিকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ২০১০ সালে তিনি অভ্র কীবোর্ডের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করেন এবং অভিযোগ তোলেন যে অভ্র নাকি বিজয়ের ফন্ট চুরি করেছে। তবে আদালতে এই অভিযোগের কোনো সত্যতা মেলেনি এবং অভ্রর নির্মাতা নির্দোষ প্রমাণিত হন। এর পরেও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভ্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলে। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থা বিজয় কীবোর্ডকেই একমাত্র সরকার-অনুমোদিত বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ দেয়, যা অভ্রর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। তা সত্ত্বেও অভ্রর জনপ্রিয়তা কমেনি, বরং দিন দিন এটি আরও ছড়িয়ে পড়ে
মেহেদী হাসান খান শুধু অভ্র তৈরির মধ্যেই থেমে থাকেননি, তিনি এটি উন্নত করতে একটি দল গঠন করেন, যা ওমিক্রন ল্যাব নামে পরিচিত হয়। এই দলে যুক্ত হন রিফাত-উন-নবী, তানবিন ইসলাম সিয়াম, শাবাব মুস্তফা, নিপন ও অন্যান্য প্রযুক্তিবিদরা। তার স্ত্রী সুমাইয়া নাজমুনও অভ্রর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, বিশেষ করে ডিকশনারি তৈরির ক্ষেত্রে। ২০০৭ সালে অভ্র কীবোর্ডকে ওপেন সোর্স করা হয়, যা বিশ্বের যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এটি ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। এটি শুধু বাংলা কম্পিউটিং নয়, পুরো মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলনের জন্যও বড় সাফল্য ছিল
বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্প, সরকারি দপ্তরসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান অভ্র ব্যবহার করেছে। মাইক্রোসফটের ইন্ডিক ভাষার সমাধান হিসেবেও অভ্র স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) তাকে বিশেষ অবদান পুরস্কার প্রদান করে। ২০১৬ সালে তিনি টেন আউটস্ট্যান্ডিং ইয়াং পারসনস (TOYP) অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এত কিছুর পরও দীর্ঘদিন ধরে সরকারিভাবে তাকে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ২০২৪ সালে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে, যার ফলে নতুন প্রশাসন ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রকৃত অবদানকারীদের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের একুশে পদকের জন্য মেহেদী হাসান খান মনোনীত হন
বাংলাদেশে একুশে পদক দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিসেবে গণ্য হয়। এটি সাধারণত ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্প-সংস্কৃতিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করা হয়। প্রযুক্তি ও ভাষার বিকাশে অসামান্য অবদান রাখলেও মেহেদী হাসান খান এতদিন এই সম্মাননা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। অভ্রর মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ বাংলা টাইপিংয়ের সুযোগ পেলেও তিনি প্রচারের আলোয় আসতে চাননি। কিন্তু তার এই স্বীকৃতি পাওয়া শুধু তার নয়, পুরো মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলনের বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে
এই ঘোষণার পর থেকে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, ভাষা আন্দোলনের কর্মী এবং সাধারণ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। অনেকেই বলছেন, এটি কেবল একজন ব্যক্তির স্বীকৃতি নয়, বরং বাংলা ভাষার বিজয়। যারা ভাষাকে বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতীকী জয়। অভ্র কীবোর্ড তৈরি করে মেহেদী হাসান খান বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তির জগতে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার একুশে পদক অর্জন প্রমাণ করে, সত্যকে বেশিদিন দমিয়ে রাখা যায় না। দেরিতে হলেও বাংলা ভাষার প্রকৃত যোদ্ধারা তাদের যথাযথ স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছেন
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।