মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে গ্রীষ্মের শুরুতেই প্রকৃতি যেন আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। শহরের প্রধান সড়কগুলো, দ্বীপপথ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে এখন ছড়িয়ে পড়েছে নানা রঙের ফুলের বাহার। বিশেষ করে সোনালু, ক্যাসিয়া, জারুল, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, কুরচি ও বিলুপ্তপ্রায় হুরহুরে ফুলের সৌন্দর্যে পুরো এলাকা যেন এক স্বপ্নীল রূপ ধারণ করেছে। এই দৃশ্যপট শুধু স্থানীয়দেরই নয়, আকর্ষণ করছে দূর-দূরান্ত থেকে আগত ভ্রমণপ্রেমীদেরও।
সরেজমিনে দেখা যায়, শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কজুড়ে বিশাল বিশাল বৃক্ষরাজির নিচে ফুটে থাকা ফুলের পাপড়ি বাতাসে দুলছে। যানবাহনে বসে জানালার বাইরে চোখ রাখলেই চোখে পড়ছে হলুদ সোনালুর ঝাড়, কৃষ্ণচূড়ার লাল জ্যোতি, ক্যাসিয়ার গোলাপি আভা। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি চা-বাগান আর তার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে থাকা এই ফুলগুলো প্রকৃতিকে করে তুলেছে আরও বেশি সজীব ও মনোহর।
শ্রীমঙ্গল শহরের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি শান্তিবাগ ওয়াকওয়ে, কোদালীপুল, কোর্ট রোডসহ শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কের বিভিন্ন অংশ যেন ফুলের অভ্যর্থনায় সেজেছে। পথচারীরা হাঁটছেন এই সুশোভিত পথে আর মাঝে মাঝে থেমে মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করছেন প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য। অনেকেই বলছেন, প্রতি বছর এই সময় এলেই শ্রীমঙ্গলের রাস্তাগুলো যেন একেকটি ফুলবাগানে পরিণত হয়।
মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের ছাত্রী নিশিতা আঞ্জুম জানিয়েছেন, প্রতিদিন কলেজে যাওয়ার সময় রাস্তায় চোখ পড়লেই মনে হয় যেন ফুলের দেশে প্রবেশ করেছি। সোনালুর হলুদ ঝাড় আর কৃষ্ণচূড়ার লাল গুচ্ছ তাকে প্রতিদিন নতুন করে মুগ্ধ করে। অন্যদিকে খুলনা থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা ইয়াছিন মিয়া জানিয়েছেন, ভানুগাছ সড়কের ফুলেল সৌন্দর্য তার জীবনের অন্যতম সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
প্রাকৃতিক রূপে মোহিত স্থানীয় শিক্ষকরাও। কুঞ্জবন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক একরামুল কবীর জানান, এই সময়ে পুরো এলাকা কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙে ছেয়ে যায়। বিকেলে সূর্যের আলো ফুলের ওপর পড়লে মনে হয় আগুন জ্বলছে। এই সৌন্দর্যে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তিও দূর হয়ে যায়।
এবার মৌলভীবাজার শহরে দেখা মিলেছে বিরল হুরহুরে ফুলেরও। কোদালীপুল এলাকায় ফুটেছে এই বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ, যা সাধারণত দেখা যায় না শহরাঞ্চলে। এর সাদা, বেগুনি, গোলাপি রঙের ফুল ও শামুকের খোলস সদৃশ বীজ এই গাছটিকে করেছে আকর্ষণীয়। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি খরা সহ্য করতে পারে এবং বৈরী পরিবেশেও টিকে থাকতে সক্ষম।
শান্তিবাগ ওয়াকওয়েতে এ বছরই প্রথমবার দেখা গেছে কুরচি ফুল। এই ক্ষুদ্রাকৃতি সাদা ফুলের ঝাড়ে পথচারীরা থমকে দাঁড়াচ্ছেন, ছবিও তুলছেন। শরীরচর্চা করতে আসা বিকাশ ভৌমিক জানিয়েছেন, কুরচি গাছের আশেপাশে হাঁটলে তার মিষ্টি সুগন্ধ মনকে তাজা করে তোলে।
প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেনের মতে, কুরচি আমাদের বনাঞ্চলে দুর্লভ হলেও শহরে এর উপস্থিতি প্রকৃতির সাথে নগরের বন্ধনের নিদর্শন। নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন, কুরচির শুভ্রতা প্রকৃতিকে নিঃশব্দে সৌন্দর্যের বার্তা দেয়। চৈত্রের রোদে যখন অন্য ফুল থেমে যায়, কুরচিই তখন প্রকৃতির রঙ ধরে রাখে।
এইসব ফুলের সৌন্দর্যে মৌলভীবাজার এখন এক মোহময় প্রকৃতির শহর। যার প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি গাছ আর প্রতিটি ফুল যেন চোখে এনে দেয় প্রশান্তি আর মনে জাগায় ভালোবাসা। এই সৌন্দর্য ধরে রাখতে শহরের বৃক্ষরোপণ পরিকল্পনা আরও সুসংগঠিত করা দরকার, যেন প্রকৃতির এই রূপ আগামী দিনেও থেকে যায় প্রাণবন্ত।