প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪, ৩:৯
আজ মধ্যরাত থেকে শুরু হচ্ছে দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের প্রজনন, মাছের বংশ বিস্তার বাড়াতে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। এ সংক্রান্ত প্রঞ্জাপন জারি করেছে মৎস্য সম্পদ মন্ত্রণালয়।
এদিকে নিষেধাজ্ঞার কারনে দক্ষিণাঞ্চলের লাখো সমুদ্রগামী জেলের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। তারা বলছেন, বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে বিভিন্ন ধাপে ১৪৭ দিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ায় লাখো জেলে ও ব্যবসায়ীর মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। জেলেরা যে সরকারি সহায়তা পান, তা অপ্রতুল। তাছাড়া নির্দিষ্ট সময় এবং নির্দিষ্ট পরিমান সহায়তাও পাননা বলে অভিযোগ তাদের। ফলে তাদের জীবন কাটে চরম দুর্দশায়। মা ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, মার্চ-এপ্রিল ৬০দিনের অভয়াশ্রমের শেষ হতে না হতেই আবার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
এদিকে বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার ৩৭ দিন আগে সাগরে নামবে ভারতের জেলেরা। আর এতে করে লাভবান হবেন তারা। বাংলাদেশী জেলেদের দাবি, মৎস্যসম্পদ রক্ষার স্বার্থে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞার সময় এক হওয়া জরুরি। তবে মৎস্য কর্মকর্তাদের দাবি, বাংলাদেশ, ভারত ও মায়ানমারের সমুদ্রসীমায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ও মৌসুম ভিন্ন ভিন্ন। আর গবেষণা এবং জেলেদের সাথে কথা বলেই নিষেধাজ্ঞা সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। আর নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র সাগরে, নদীতে নয়। তাছাড়া নিষেধাজ্ঞাকালীন বিভাগের ৩২টি উপজেলার ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ২৯জন জেলেদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা দেয়া হয়। তাই জেলেদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়।
সূত্রমতে, ভারতে ৬১ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় ১৫ এপ্রিল, শেষ হয় ১৪ জুন। আর বাংলাদেশে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় ২০ মে, শেষ হয় ২৩ জুলাই। বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ৩৮ দিন ভারতের জেলেরা বাংলাদেশ জলসীমানাতে ঢুকে ইলিশসহ অন্য মাছ ধরার সুযোগ পান বলে জানান ট্রলারমালিক ও জেলেরা। মিয়ানমারের জেলেরাও মাছ ধরে নিয়ে যান এ সময়। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ওপর বাংলাদেশ ও ভারতের পৃথক নিষেধাজ্ঞাতে বাংলাদেশি জেলেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মৎস্যসম্পদ রক্ষার স্বার্থে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞার সময় এক হওয়া জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট সবাই।
জেলে ও ট্রলারমালিকরা বলেন, উপকূলে তাপপ্রবাহ পরিস্থিতির কারণে গত এপ্রিল জুড়ে জালে ইলিশ ধরা পড়েনি। চলতি মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেও ইলিশ পাওয়া যায়নি। ১৫ মে থেকে কিছু ট্রলারে ইলিশ ধরা পড়তে শুরু হয়। কয়েক দিন ধরে গভীর সাগর থেকে ঝাঁক বেঁধে ইলিশ উপকূলের কাছাকাছি আসতে শুরু করেছে। তবে ২০ মে দিবাগত রাত ১২টা থেকে আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত সরকারি নিষেধজ্ঞা নিয়ে চিন্তিত সবাই। ভারতের জেলেরা নিষেধাজ্ঞা শেষ করে অন্তত ৩৭ দিন আগে সাগরে নামবে। দুই দেশের নিষেধাজ্ঞা একই সঙ্গে শুরু এবং শেষ হলে বাংলাদেশের জেলেরা নিষেধাজ্ঞার সুফল ভোগ করতে পারত বলে জানান জেলেরা।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র পটুয়াখালী জেলার মহিপুরের সাতভাই ফিসের পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, পটুয়াখালীর সবচেয়ে বড় দুটি মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুর। এখান থেকে কোটি কোটি টাকার মাছ চালান হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে গত কয়েক বছর যাবৎ বছরে দু’বার নিষেধাজ্ঞা, বৈরি আবহাওয়া, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি। সব মিলিয়ে এই পেশা এখন হুমকির মুখে।
ট্রলার মালিক খোকন বলেন, কোম্পানির কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা দাদোন নিয়ে দুইটা ট্রলার তৈরি করেছি। ২ বছরে এখন পর্যন্ত লাভের মুখ দেখিনি। এর উপর আবার অবরোধ, এখন এই পেশায় টিকে থাকা আমাদের মতো মানুষের পক্ষে সম্ভব না।
মাঝি সরোয়ার জানান, ট্রলারে কাজ করে গত বছর ৮০ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে, তা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। আবার ৬৫ দিনের অবরোধ, এই ঋণ পরিশোধতো দূরের কথা ঋণের বোঝা আরো বেড়ে যাবে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, অবরোধকালীন সময়ে প্রতিবছর ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমানায় মাছ ধরলেও কোনো ভূমিকা দেখা যায়না প্রশাসনের।
জেলে মাঝি কুদ্দুস মিয়া বলেন, আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ একটি দাবি করে আসছি, ৬৫ দিনের অবরোধকালে আমরা মাছ ধরা বন্ধ রাখলেও পার্শ্ববর্তী ভারতীয় জেলেরা আমাদের দেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ শিকার করে। কিন্তু সরকার এখনো এর কোনো প্রতিকার করতে পারলো না। আমাদের দাবি, এই সময়ে আমাদেরও মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতঃ নয়তো অবৈধভাবে ভারতীয় জেলে ট্রলারগুলো বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ বন্ধ করা হোক।
মহিপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘জেলেদের দাবি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হচ্ছে। এছাড়াও জেলেদের ঋণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরিকল্পনাও চলছে।’ তিনি আরও বলেন, মূলত দুটি কারণে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। প্রজনন সুবিধায় যাতে মাছ নির্বিঘেœ ডিম ছাড়তে পারে। আর অপরটি হলো- ছোট মাছকে বড় হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম জানান সাগরঘেষা হওয়ায় জেলার প্রতিটি উপজেলায়ই সমুদ্রগামী জেলে রয়েছে। তালিকাভুক্ত সমুদ্রগামী ৪৭ হাজার ৩৭১জন জেলেকে ইতোমধ্যে নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারি সহায়তা প্রদান শুরু হয়েছে। জেলেরা যাতে সরকারি সহায়তা বঞ্চিত না হন এজন্য প্রত্যেক উপজেলায় জেলেদের সচেতন করা হয়েছে। তাছাড়া এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বয়ে তদারকি করা হবে বলেন তিনি।
বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন জানান, বিভিন্ন উপজেলার জেলেরা সমুদ্রে গেলেও নির্দিষ্ট ৩টি উপজেলায় সমুদ্রগামী জেলে রয়েছেন। নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে জেলার ২৭ হাজার ২৫০জন জেলেকে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হচ্ছে।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ^জিৎ কুমার দেব জানান, তার জেলায় সমুদ্রগামী জেলে রয়েছে ৭টি উপজেলায়। সমুদ্রগামী তালিকাবদ্ধ ৬৪ হাজার জেলেকে নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা প্রদান করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জেলা টাস্ক ফোর্স কমিটির সভায় জেলেদের বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। জেলেরা যাতে সরকারি সহায়তা পান তা নিশ্চিত করতে ভিজিএফ চাল বিতরণকালে ট্যাগ অফিসারের উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মসূচির দিনক্ষণ মৎস্য কর্মকর্তাদের অবহিত করার জন্য বলা হয়েছে যাতে চাল বিতরণকালে মৎস্য অফিসের প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেন।
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (চ.দা.) নৃপেন্দ্র নাথ বিশ^াস বলেন, শুধুমাত্র ভারতই নয়, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডেও প্রজনন মৌসুম ভিন্ন। গবেষণা থেকে এমনটি দেখা গেছে। সেক্ষেত্রে যার যার দেশের প্রজনন মৌসুম অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তবে প্রতি বছরই যে একই সময় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে তা কিন্তু নির্ধারিত নয়। প্রকৃতি ও জলবায়ুর বিবেচনায় নিষেধাজ্ঞার সময় পরিবর্তন হতে পারে। জেলেদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞার সময় সাগরে যথাযথ মনিটরিং ও অভিযান চালানো হয়। তাছাড়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তিনি আরো বলেন, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কাজ করা হচ্ছে। যে যার অবস্থান থেকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে লাভবান হবে দেশ এবং দেশের অর্থনৈতিক খাত।