প্রকাশ: ৫ জুন ২০২১, ১৬:১৪
বরিশাল জেলার মেঘনা, তেঁতুলিয়াসহ দখিনের বিভিন্ন নদীতে অবাধে মশারি জাল, বিহিন্দী ও কারেন্ট জাল দিয়ে নির্বিচারে চিংড়ির রেনু পোনা (গলদা চিংড়ি) নিধনের মহোৎসব চলছে দীর্ঘদিন থেকেই। বছরের পর বছর এসব রেনু পোনা ধরতে গিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য মাছের রেনু পোনা ধ্বংস হচ্ছে প্রতিদিন। ফলে জলজ প্রাণির ওপর মারাত্মক প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, একটি চিংড়ির রেনু পোনা (পিএল-পোস্ট লাম্বা) ধরার জন্য অন্য প্রজাতির নয় থেকে ১২টি রেনু পোনা ধ্বংস করা হচ্ছে।
এ সব নিষিদ্ধ রেনু পোনা সংশি¬ষ্ট প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নিরাপদ হিসেবে সড়ক ও নদী পথ দিয়ে বড় বড় ড্রাম কিংবা পাতিল ভর্তি করে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে চালান করছে একটি প্রভাবশালী দালাল চক্র। আর দখিনের জেলাগুলো থেকে তা পাচার করতে সহযোগিতা করে গোপালগঞ্জের বাসিন্দা জনৈক টুলু ও তার সহযোগী হারুন ওরফে পাতিল হারুন, রনি, বিপ্লবসহ শতাধিক ব্যাক্তি।
ইতিপূর্বে প্রশাসনের হাতে একাধিকবার রেনুপোনাসহ আটক হলেও বরিশাল নগরীর এক রাজনৈতিক নেতার নাম ব্যবহার আইনের ফাঁক গলে অনায়াসে বের হয়ে পুরনো ব্যবসায় ফিরে যান রেনু পাচারচক্রের হোতা টুলু।
সূত্রমতে, গত বৃহস্পতিবার (৩জুন) রাতে হিজলা উপজেলাধীন মেঘনা নদীতে অভিযান চালিয়ে ১৩ লক্ষাধিক গলদা রেনু জব্দ করে কোস্টগার্ড। এ সময় রেনু পাচার কাজে ব্যবহৃত একটি নৌকা আটক করে কোস্টগার্ড। তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি কোস্টগার্ড।
একই দিন বরিশাল নৌপুলিশের অভিযানে সাড়ে ৭ লাখ গলদা চিংড়ির রেণু জব্দ করা হয়। এসময় আটক করা হয় ১৯ জেলেকে। তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমান আদালত।
এর আগে গত ৪ মে বরিশাল নগরীর রূপাতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি ট্রাক থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ চিংড়ি রেনু জব্দ করে নৌ-পুলিশ। এ ঘটনায় ওই সময় চারজনকে আটক করা হয়েছিল।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাস থেকে গলদা ও বাগধা চিংড়ির রেনুপোনা পাচার শুরু করেন সংঘবদ্ধ একটি চক্র। যার নেতৃত্বে রয়েছে গোপালগঞ্চের বাসিন্দা জনৈক টুলু ও তার সহযোগী হারুন ওরফে পাতিল হারুন, রনি, বিপ্লবসহ শতাধিক ব্যাক্তি।
জানা গেছে, বরগুনার আমতলী, তালতলী ও পটুয়াখালীর কলাপাডা, মহিপুর, কুয়াকাটা ও আলীপুরের সকল প্রশাসন, সাংবাদিক ও রাজনৈতক ব্যক্তিদের ম্যানেজ করেন দেলোয়ার নামের এক ব্যাক্তি। দেলোয়ারকে সবাই টুলুর ম্যানেজার বলে জানেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নেহালগঞ্জ ফেরীঘাট, লাহারহাট ফেরিঘাট, গোমা ফেরিঘাটসহ জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী দালাল চক্রের মাধ্যমে জেলেদের কাছ থেকে রেনু পোনা ক্রয় করে তা বড় বড় ড্রাম ভর্তি করে প্রতিদিন ১৮টি ট্রাকে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে চালান করছেন। এসব রেনু বরগুনার আমতলী, তালতলী ও পটুয়াখালীর কলাপাডা, মহিপুর, কুয়াকাটা ও আলীপুর মোকাম থেকে কমপক্ষে ১০টি এবং বরগুনা সদর থেকে দুটি ট্রাক বরিশাল হয়ে বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরায় যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরিশালের কয়েকজন পোনা ব্যবসায়ী বলেন, ট্রাকভেদে ১৮ থেকে ৩০টি পাতিল বহন করা যায়। একেকটি পাতিলে ১০ হাজার করে পোনা বহন করা হয়। সে অনুযায়ী প্রতিটি ট্রাকে এক লাখ ৮০ হাজার থেকে তিন লাখ পোনা বহন করা হয়। সেই হিসাবে প্রতিদিন এই তিন পথে ৩০টি ট্রাকে গড়ে ৬০ লাখ পোনা পাচার হয়। এ ছাড়া নদীপথে ট্রলারে করে পাচার হয় কমপক্ষে আরও ৪০ লাখ পোনা। বাগদা রেণুর প্রতি হাজার এক হাজার টাকায় কিনে মোকামে দেড় হাজার এবং গলদা পোনা দেড় হাজার টাকায় কিনে মোকামে দুই হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়।
বরিশালের নৌ পুলিশ সুপার মোঃ কফিলউদ্দিন বলেন, অবৈধভাবে রেনুপোনা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চলছে। মূলহোতা যে-ই হোক না কেন কোন পাচারকারীকে নৌ-পুলিশ বিন্দুমাত্র ছাড় দিবে না।
তিনি আরো বলেন, শুধু রেনুপোনা পাচারকারীই নয়, অবৈধ কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জাল, জাটকা নিধন, অভয়াশ্রমে মাছ ধরাসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত সব অবৈধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধেই নৌ-পুলিশের অভিযান চলমান আছে।
বরিশাল কোষ্টগার্ড দক্ষিণ জোনের স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট ওয়াসিম আকিল জাকী (এক্স) বি.এন বলেন, বরিশাল থেকে রেনুপোনা পাচার হচ্ছে এমন সংবাদ আসলে সাথে সাথেই পাচারকারীদের ধরতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। পাচারকারীরা যত শক্তিশালী হোক তাদের সাথে কোন আপোষ নয়, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে মূল হোতাদের প্রশ্নে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে কোস্টগার্ডের গোয়েন্দা শাখায় যোগাযোগ করতে বলেন।
বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, তারাও এই সব অবৈধ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছেন এবং তাদের এ অভিযান চলমান থাকবে।
তিনি বলেন, একটি চিংড়ির রেনু পোনা (পিএল-পোস্ট লাম্বা) ধরার জন্য অন্য প্রজাতির নয় থেকে ১২টি রেনু পোনা ধ্বংস করা হচ্ছে। এরমধ্যে দুই হাজার প্রজাতির মাছ ও বিভিন্ন প্রকারের জলজপ্রাণি প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে। যে কারনে মেঘনা, তেঁতুলিয়াসহ দখিনের নদীতে অন্য প্রজাতির মাছ ও অনান্য জলজপ্রাণির ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণেই সরকার বাগদা ও গলদা প্রজাতির রেনু পোনা আহরণ ও সংরক্ষণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।