৮০০ একর জমির সরকারি খাল উদ্ধারে কৃষকের স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক
এম সোহেল, রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সোমবার ২৮শে নভেম্বর ২০২২ ০৫:১৩ অপরাহ্ন
৮০০ একর জমির সরকারি খাল উদ্ধারে কৃষকের স্বস্তি

‘জাল যার, জলা তার’ এই নীতি বদলে দিয়েছিল প্রতাপশালীরা। এখানে ‘ক্ষমতা যার, জলা তার’ এমন নীতিই চলছিল। একসময়ের প্রবহমান পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর খাল-নালাগুলো কব্জায় নিয়ে চলছিল মাছ চাষ বাণিজ্য। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল প্রান্তীক কৃষকরা। তবে এখন দখলদারদের হাত থেকে ছুঁটছে খাল-নালাগুলো। 


গত দেড় মাসে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দখল হওয়া এরকম ৮০০ একর জমির সরকারি খাল উদ্ধার করেছে প্রশাসন। দ- দেওয়া হয়েছে ১৪ জন দখলদারকে। এতেই নড়েচড়ে বসেছেন সরকারি খাল দখল করা প্রতাপশালীরা। তবে এখনও ছোট-বড় প্রায় এক শ’ খাল বেদখল হয়ে আছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, খালগুলো উদ্ধারে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। 


উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ অক্টোবর থেকে উপজেলার বিভিন্ন খাল-নালা উদ্ধারে  অভিযান শুরু করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।  উপজেলা ভূমি সহকারী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ইতোমধ্যে ছয়টি খালের ২৯টি বাঁধ কেটে প্রায় ৮০০ একর জমির সরকারি খাল উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব খালের ১১ জন দখলদারকে ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া ৩ জনকে দেয়া হয়েছে কারাদন্ড।  


স্থানীয় কৃষকরা জানান, এসব সরকারি খাস খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করতো প্রভাবশালীরা । এতে বর্ষা মৌসুমে ফসলি খেতে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষকরা।  তারা বলছেন, শুকনো মৌসুমে প্রভাবশালীদের দখল করা খাল থেকে পানি ক্রয় করে চাষাবাদ করতে হতো। এখন যে ক’টি খাল দখলমুক্ত হয়েছেÑওইসব খালের আশপাশের কৃষকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, দখলমুক্ত হওয়ায় খাল এলাকাগুলোতে প্রায় ৭০০ কৃষকের ৫০০ হেক্টর জমি চাষাবাদ উপযোগী হয়েছে।  


উপজেলার সদর ইউনিয়নের সেনের হাওলা গ্রামের কৃষক সায়েম হোসেন বলেন, ‘আমাদের এখানের  বাঙরের খালটি (জায়দার খাল) দীর্ঘদিন ধরে দখল করে মাছ চাষ করা হচ্ছিল। সেই খালের বাঁধ কেটে উন্মুক্ত করায়  প্রায় ২০০ একর জমির চাষী উপকৃত হয়েছে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার একাধিক কৃষক জানান, দখল করা খালগুলোর পানিও বিক্রি হতো। সেই পানি কিনে চাষাবাদ করতে হতো কৃষকদের। 


এখনও শত খাল বেদখল, অভিযান অব্যাহত: প্রশাসনের তথ্য বলছে, জনস্বার্থে এবং সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারে প্রশাসনের এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে অভিযানের পরও ছোট-বড় প্রায় এক শ’ খাল দখল করে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।      


তেমনি একটি খালের নাম ‘এছবখালীর খাল’। একসময়ের খর¯্রােতা উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের টুঙ্গিবাড়িয়া গ্রামের এ খালটি  বাঁধ দিয়ে দখল করে রাখা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে,  একেক করে ৮টি বাঁধ দেওয়া হয়েছে খালটিতে। করা হয়েছে মাছ চাষ। এরকম শুধু এছবখালীর খালই নয়, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ইউনিয়নের জহরউদ্দির খাল, কাটাখালীর খাল, মৌডুবি ইউনিয়নের হারির খাল, ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের ভাঙ্গার খাল, ছোটবাইশদিয়া গ্রামের ডাঙ্গার খাল, নয়াভাঙ্গুনীর খাল এবং কাউখালীর চরের মালেকার খালসহ উপজেলায় প্রায় শতাধিক  খালে বাঁধ দিয়ে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ করে দখল করে রাখা হয়েছে। করা হয়েছে মাছ চাষ। সচেতন নাগরিকদের মতে, চলমান অভিযানের ধারাবাহিকতায় দখল হওয়া বাকি খালগুলোও উদ্ধার হলে একদিকে কৃষকরা উপকৃত হবেন। অন্যদিকে সরকারের সম্পত্তিও উদ্ধার হবে।        


উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন যাবত  আমাদের বেশ কিছু সমস্যা ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রকৃতির খাল (সরকারী খাস খাল) সেগুলো ব্যক্তি উদ্যোগে আটকে রাখা হয়েছিল। প্রভাবশালী ওইসব লোকজন তাদের মতো দখল করে রেখেছিল। বর্তমান জেলা প্রশাসক মহোদয়ের  নির্দেশে উপজেলা প্রশাসন ও  নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান পরিচালনা করে কাজির হাওলার খাল, সেনের হাওলা, বিষার খালসহ এরকম বড় বড় অনেকগুলো খাল  ইতোমধ্যে উদ্ধার করেছে। এতে করে আনুমানিক প্রায় ৫০০ হেক্টর চাষাবাদ ব্যাহত জমি যথাযথ চাষযোগ্যের আওতায় এসেছে। এতে প্রায় ৭০০ কৃষক উপকৃত হবে। 


তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা সøুইসগেটগুলো প্রশাসনের উদ্যোগে যথাযথ  নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে। ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো থাকায় ব্রো ধানসহ বিভিন্ন রবি শষ্য ফসলগুলোর ফলন বৃদ্ধি পাবে।


জানতে চাইলে সরকারি খাল উদ্ধার অভিযান পরিচালনাকারী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মদ সালেক মূহিদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালীদের দখলে থাকা সরকারী খালগুলো বাঁধ কেটে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ওইসব দখলদারদের দখলে থাকা ছয়টি খালের ২৯টি বাঁধ কেটে প্রায় ৮শ’ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ৬ঙ লঙ্ঘনের অভিযোগে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী দন্ডপ্রদানসহ জরিমানা করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত আছে।’   


এ ব্যাপারে পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনের সংসদ সদস্য মহিব্বুর রহমান মহিব বলেন, ‘রাঙ্গাবালীতে প্রচুর খাল-বিল, নদী-নালা, জলাশয় এবং স্লুইজগেট রয়েছে। এগুলো বিভিন্ন লোকজন বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে তারা ভোগ করতেছিল। আমি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে খাল নালাগুলোর ইজারা বন্ধ আছে। সম্প্রতি উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে খাল-নালা এবং স্লুইসগেট উন্মুক্ত ঘোষণা করেছি। পাশাপাশি বলেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মসূচী ছিলো যে ‘জাল যার, জলা তার’। সেই স্লোগানকে সামনে রেখে নেত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন হয় সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে প্রশাসনকে।’