অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের চীন সফর বাংলাদেশের জন্য বহুমুখী গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এই সফর শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সফর নয়, বরং এটি বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগী। এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায়। বিশেষত, চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আকৃষ্ট করা এবং বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্পে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই এই সফরের অন্যতম লক্ষ্য। চীন ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে (যেমন: পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর) বিনিয়োগ করেছে। এই সফরের মাধ্যমে আরও নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হতে পারে, বিশেষ করে উৎপাদনশীল শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে।
বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য সংযোগ স্থাপনে সহায়ক। চীনের মতো একটি বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশ ও চীনের বাণিজ্য সম্পর্ক অসম, যেখানে বাংলাদেশ বেশি আমদানি করে, কিন্তু রপ্তানি তুলনামূলকভাবে কম। এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের কৌশল গ্রহণ করতে পারে।
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য বেশ অসম। বাংলাদেশ চীন থেকে ব্যাপক পরিমাণে পণ্য আমদানি করে (বিশেষত কাঁচামাল, ইলেকট্রনিকস, যন্ত্রপাতি ও টেক্সটাইল সামগ্রী), কিন্তু তুলনামূলকভাবে চীনে কম রপ্তানি করে। চীনের বাণিজ্য নীতি অনুসারে, তারা বাংলাদেশকে রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ দিতে চায়, তবে তা মূলত বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা ও বাজার চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। ২০২০ সালের জুলাই থেকে চীন বাংলাদেশকে ৯৭% পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। ফলে প্রায় ৮,২৫৬টি পণ্য (ট্যারিফ লাইনের ভিত্তিতে) চীনা বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানি করা যায়। এতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, চামড়া, কৃষিপণ্য ও অন্যান্য শিল্পখাতের জন্য বড় বাজার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (ইওআরআই)-এর একটি অংশ, যা চীনকে দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সহায়ক করে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে চীন বাংলাদেশে বাণিজ্যিক রুট, রেললাইন, এবং সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে।
অপরদিকে, চীনের বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং কৌশলগত কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলা করতে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থান শক্তিশালী করতে চায়, যেখানে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে। ফলে চীন তার বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।
চীনের বাণিজ্য নীতির একটি বড় অংশ হলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। চীন সরাসরি বাংলাদেশে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ঝঊত) স্থাপন। যেহেতু ভারতের সাথে বর্তমানে চিকিৎসা ভিসা বন্ধ আছে, সেহেতু এই সফরের সময় স্বাস্থ্য খাতে চীনা বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হবে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি বৃহৎ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ যদি চীনের সঙ্গে একটি বড় চিকিৎসা চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাহলে এটি বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে, তবে এর গভীরতা নির্ভর করবে চুক্তির ধরন ও পরিধির ওপর।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত (বিশেষ করে কলকাতা, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালুরু, দিল্লি) যায়। যদি চীন বাংলাদেশে আধুনিক হাসপাতাল স্থাপন করে বা বিশেষ চিকিৎসা সুবিধা দেয়, তবে বাংলাদেশি রোগীদের চীনের দিকে ঝোঁক বাড়তে পারে। এটি ভারতের চিকিৎসা পর্যটন ব্যবসায় প্রভাব ফেলতে পারে। ভারত সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি বাড়ানোকে কৌশলগতভাবে সন্দেহের চোখে দেখে। যদি চীন বাংলাদেশে বড় আকারের স্বাস্থ্য খাত বিনিয়োগ করে, তাহলে ভারত মনে করতে পারে যে এটি শুধু চিকিৎসা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত অংশীদারিত্বের একটি দিক। এর ফলে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি চুক্তি করতে পারে বা কিছুটা কূটনৈতিক উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সুযোগ, তবে এটি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কৌশলী হতে হবে। যদিও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক, তবে এটি নির্ভরশীলতার দিকে যেন না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। চীনের ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ রয়েছে, কারণ অতিরিক্ত ঋণ ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই বাংলাদেশের উচিত স্বচ্ছ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা, যাতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নেওয়া যায়, তবে ঋণের ফাঁদে পড়া এড়ানো যায়।
বাংলাদেশ ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার নীতি অনুসরণ করে। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়লেও, ভারতকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত নেই। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বেশ দৃঢ়। উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য, ট্রানজিট, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক রয়েছে, যা শুধু চীন- বাংলাদেশ সম্পর্কের কারণে নষ্ট হবে না। ভারত সম্ভবত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাইবে এবং নতুন বাণিজ্য বা বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে, যাতে বাংলাদেশ চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল না হয়। ড. ইউনুস এর সফর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না, তবে কিছু প্রতিযোগিতামূলক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। তবে যদি বাংলাদেশ কৌশলী কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রাখে, তাহলে উভয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখা সম্ভব।
বাংলাদেশের অবস্থান ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। দুই প্রতিবেশী শক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা এবং প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বাংলাদেশকে একটি কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে। কারণ ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন, চিকিৎসা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অপরদিকে, চীন বাংলাদেশের বড় অর্থনৈতিক অংশীদার, যাদের কাছ থেকে উন্নয়ন সহায়তা এবং অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ পাওয়া যাচ্ছে। চীন বাংলাদেশের বিশাল বাজার হিসেবে বিবেচিত এবং এই সম্পর্কের মাধ্যমে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুসের চীন সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে। এটি শুধু বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ককে আরও গভীর করতে চায়, বিশেষত অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য এবং বিনিয়োগ খাতে। তবে, এই সম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশকে ভারতসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, যাতে কোনো একটি দেশের প্রতি নির্ভরশীলতা এড়ানো যায় এবং জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। এমনকি যদি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়, তবে বাংলাদেশ তার ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি বজায় রেখে এই সম্পর্ককে সুফলজনকভাবে পরিচালনা করতে পারবে। ড. ইউনুসের সফর তার গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক দক্ষতা এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি বিশ্বস্ততার প্রমাণ হতে পারে, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সুষ্ঠু পররাষ্ট্রনীতি, এবং কৌশলগত স্বার্থের সুরক্ষা সবই সমান ভাবে বিবেচিত।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়