ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই বন্ধন ,ঈদ মানে উৎসব ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুখস্মৃতি। আর এই আনন্দের অন্তরালে রয়েছে লাখো প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিরলস পরিশ্রম ও ত্যাগ। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বিশেষ করে ঈদের আগে বাজারে প্রাণসঞ্চার করেছে। পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর পাশাপাশি অর্থনীতি চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা যেমন বজায় থাকছে, তেমনই বাজারে কেনাকাটা ও বিনিয়োগের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে ।
রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত লক্ষ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশি তাদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশে পাঠান। এই রেমিট্যান্স সরাসরি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ মাসের প্রথম ২২ দিনে দেশে এসেছে ২৪৩ কোটি ৭৫ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ২৯ হাজার ৭৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসেবে)।
সৌদি আরব বাংলাদেশি প্রবাসীদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য,এবং সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে এখান থেকে।তাছাড়াও দুবাই, আবুধাবি, যুক্তরাষ্ট্র ,কুয়েত,ওমান ,কাতার, মালয়েশিয়া , সিঙ্গাপুর, বাহরাইন, জর্ডান, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ফ্রান্স থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে।তারা বিভিন্ন দেশে গিয়ে নানা ধরনের কাজ করে থাকেন। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকেরা প্রধানত নির্মাণ শিল্পে কাজ করেন। তারা বিল্ডিং, সড়ক, ব্রিজ নির্মাণ, প্লাম্বিং, বৈদ্যুতিক কাজ ইত্যাদি করেন।তাদের কর্মক্ষেত্রের বৈচিত্র্য দেশের প্রয়োজন ও প্রবাসীদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে।
প্রবাসী শ্রমিকেরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স পাঠান। রেমিট্যান্স পাঠানোর পদ্ধতিটি তাদের বসবাসকারী দেশের নীতিমালা, প্রযুক্তি এবং উপলব্ধ ব্যাংকিং সুবিধার ওপর নির্ভর করে। যেমন, বিভিন্ন ব্যাংকিং চ্যানেল, মোবাইল ব্যাংকিং(নগদ (Nagad), বিকাশ (Bkash), রকেট (Rocket ), হুন্ডি (হুন্ডি হলো একটি অস্বীকৃত (অবৈধ) পদ্ধতি, যেখানে প্রবাসী সরাসরি একটি নির্দিষ্ট দালালের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠান। এই পদ্ধতিতে টাকা কোনও ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ব্যবহার না করে লোকাল চ্যানেলের মাধ্যমে পৌঁছানো হয়), কিছু দেশ বা অঞ্চলে, প্রবাসীরা পোস্ট অফিস বা অন্য যেকোনো স্থানীয় রেমিট্যান্স সার্ভিস ব্যবহার করে টাকা পাঠান।
কারন তারা রেমিট্যান্স পাঠানোর সময় বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যাগুলির মধ্যে আর্থিক, প্রযুক্তিগত, এবং প্রক্রিয়াগত নানা বাধা । রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য অনেক সময় ব্যাংক বা ট্রান্সফার সার্ভিসগুলো উচ্চ লেনদেন ফি বা কমিশন চার্জ করে। বিশেষত, ছোট পরিমাণ অর্থ পাঠানোর সময় এই খরচ অনেকটা বেড়ে যায়, যা প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। অনেক সময় রেমিট্যান্স পাঠানোর পর, তা পৌঁছাতে কয়েকদিন বা সপ্তাহও লেগে যেতে পারে। এই বিলম্বের কারণে প্রবাসীদের পরিবার তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ ততটুকু সময় পায় না।কিছু প্রবাসী হুন্ডি বা অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠান, কারণ এর মাধ্যমে তারা কম খরচে এবং দ্রুত অর্থ পাঠাতে পারেন। তবে এটি এক ধরনের ঝুঁকি, কারণ এটি বৈধ নয় এবং প্রবাসী শ্রমিকরা দণ্ডিত হতে পারেন।হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর ফলে দেশের অর্থনীতিতে আঘাত আসে এবং সরকারও রেভেনিউ হারায়।
রেমিট্যান্স পাঠানোর সবচেয়ে সহজ, নিরাপদ ও দ্রুততম পদ্ধতিগুলি এখন ব্যাংকিং চ্যানেল, মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার সিস্টেম। তবে প্রবাসী শ্রমিকদের সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার এবং তাঁদের জন্য একটি কার্যকরী, কম খরচে সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও উদ্যোগী হতে পারে। সরকারে উচিএ হবে ব্যাংকিং সিস্টেমে আধুনিকীকরণ এবং কম খরচে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা, ডিজিটাল ও মোবাইল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মে উন্নতি ,সরকারি উদ্যোগ ও প্রণোদনা, রেমিট্যান্স সেবা প্রদানকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি ,প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি।
ঈদের বাজারে রেমিট্যান্সের প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এবং স্থানীয় বাজারে বিশেষ করে ঈদ উপলক্ষে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। রেমিট্যান্স প্রবাসী শ্রমিকদের দ্বারা পাঠানো অর্থ, যা তাদের পরিবারের জন্য সাহায্য হিসেবে আসে, বিশেষ করে ঈদের সময় একটি বিশাল অর্থনৈতিক প্রবাহ সৃষ্টি করে। ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহার মতো গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবের আগে বাংলাদেশের বাজারে সাধারণত চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ঈদের সময় পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন পোশাক, খাদ্য সামগ্রী, মিষ্টি, উপহার এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়ে। এই সময় রেমিট্যান্স প্রভাব ফেলে বিশেষভাবে কারণ প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের পরিবারের জন্য এই খরচগুলো বহন করেন ।
আবার, ঈদের আগে রেমিট্যান্স আসার কারণে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা করার জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করেন। ঈদে চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে পারেন এবং বেশ কিছু নতুন অফার বা ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা করে থাকে। যেহেতু রেমিট্যান্স প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারের কাছে পৌঁছায়, তারা এটি দিয়ে সাধারণত খাদ্যসামগ্রী, কাপড়, গহনা, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ক্রয় করে। এর ফলে স্থানীয় উৎপাদনশীলতা এবং ছোট ব্যবসায়ীদের বিক্রি বাড়ে। অনেক পরিবার গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় দোকান থেকে এসব পণ্য কিনে থাকে, যা তাদের জীবিকা এবং এলাকার অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সহায়তা করে।
রেমিট্যান্স ঈদের বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এটি শুধু প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরে কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি করে। ঈদের সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ স্থানীয় বাজারে অর্থনৈতিক প্রবাহকে জোরদার করে এবং বাজারে চাহিদার বৃদ্ধি এবং ব্যবসায়ের প্রসারে সহায়তা করে। তাই রেমিট্যান্স বাংলাদেশের ঈদকালীন অর্থনৈতিক চক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে দাঁড়ায়।
এবারের ঈদুল ফিতরের সময় রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে। প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের পরিবারের জন্য ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বড় পরিমাণে অর্থ পাঠিয়েছেন, যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহায়ক হয়েছে।যেমন,ভোক্তব্যয়ের বৃদ্ধি, ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রসার, স্থানীয় উৎপাদন ও ছোট ব্যবসায়ীদের সুবিধা, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
তাছাড়া এবারের ঈদে রেমিট্যান্সের প্রবাহ অনেক বেশি হওয়ার কারণে সরকারের জন্য বেশ কিছু সুবিধা এবং উপকারিতা হয়েছে। রেমিট্যান্স একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উৎস, যা দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিককে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। এই অর্থের প্রবাহ দেশের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য বিভিন্নভাবে সহায়ক হয়েছে।
রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক ঋণ, আমদানি ব্যয় এবং অন্যান্য বৈদেশিক অর্থনৈতিক কাজের জন্য যে মুদ্রা ব্যবহার করে, তা প্রভাবিত হয় রেমিট্যান্সের মাধ্যমে। রিজার্ভের উন্নতি হয়েছে। ঈদের সময় রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে অর্থ বাজারে প্রবাহিত হয়, তা বিভিন্ন ধরনের পরোক্ষ কর যেমন ভ্যাট, ট্যাক্স এবং অন্যান্য ফি আদায়ে সহায়ক হতে পারে। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে অর্থ আসে, তা সামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে যোগ করে, যার মাধ্যমে সরকার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সক্ষম হয়।
এবারের ঈদে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের সরকার বেশ কিছু সুবিধা লাভ করেছে। এর মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, জাতীয় অর্থনীতির শক্তিশালীকরণ, সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি, এবং উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করেছে এবং সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়েছে।
ঈদের সময় রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ দেশের বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নতুন গতির সঞ্চার করে। প্রবাসীরা তাদের পরিবারের জন্য যে অর্থ পাঠান, তা শুধু তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে না, বরং তা দেশের স্থানীয় বাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য, এবং সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও সহায়ক হয়।
এবারের ঈদে রেমিট্যান্সের ছোঁয়া দেশের অর্থনীতিকে অনেকটাই শক্তিশালী করেছে, যার ফলে ভোক্তব্যয়, ব্যবসায়িক কার্যক্রম, এবং সামাজিক উন্নয়নেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সরকারের জন্যও এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ, কারণ রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়, যা দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়ায়।
অতএব, রেমিট্যান্স প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান এবং ঈদ উপলক্ষে তাদের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতির প্রতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলে, যা শুধু তাদের পরিবারগুলোকেই লাভবান করে না, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও সহায়ক হয়।
লেখক: বিজয় কুমার, সাবেক শিক্ষার্থী , যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।