সুন্দর চেহারা আর রূপের ঝলক দিয়ে কামিয়ে নেন শতকোটি টাকা ঃ জান্নাত আরা হেনরী

নিজস্ব প্রতিবেদক
পারভেজ সরকার, জেলা প্রতিনিধি, সিরাজগঞ্জ
প্রকাশিত: শনিবার ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:৪৭ অপরাহ্ন
সুন্দর চেহারা আর রূপের ঝলক দিয়ে কামিয়ে নেন শতকোটি টাকা ঃ জান্নাত আরা হেনরী

সাদামাটা গৃহবধূ, সংগীতশিল্পী এবং স্কুল শিক্ষিকা থেকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক নেত্রী বনে যাওয়া জান্নাত আরা হেনরীর জীবন এক রূপকথার গল্পের মতো। তবে তার এই উত্থান যেমন চমকপ্রদ, তেমনি বিতর্কিতও। সিরাজগঞ্জের এই প্রভাবশালী নেত্রী, যিনি একসময় ছিলেন এক সাধারণ গৃহবধূ, এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের মাধ্যমে তার ভাগ্য বদলে যাওয়ার পেছনে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে।



সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের সদানন্দপুর গ্রামের আব্দুল হামিদ মিঞার মেয়ে জান্নাত আরা হেনরী। তার জীবন বদলে যায় যখন তিনি জেলার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক মোতাহার হোসেন তালুকদারের ছেলে শামীম তালুকদার লাবুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। সেইসঙ্গে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।


বিবাহসূত্রে রাজনৈতিক পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুবাদে জান্নাত আরা হেনরী আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের পদ পান।



২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে তৃণমূল ভোটে অংশগ্রহণ করেন জান্নাত আরা হেনরী। সেই নির্বাচনে প্রথম হয়েছিলেন দলের বর্ষীয়ান নেতা মোহাম্মদ নাসিম। কিন্তু দুর্নীতির মামলায় মোহাম্মদ নাসিম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলে, জান্নাত আরা হেনরীর ভাগ্য খুলে যায়। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান। তবে নির্বাচনে সারা দেশে আওয়ামী লীগের জয়জয়কারের মধ্যেও জান্নাত আরা হেনরী পরাজিত হন।



নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পরও জান্নাত আরা হেনরীর রাজনৈতিক উত্থান থামেনি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জান্নাত আরা হেনরীকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য করা হয়। এখান থেকেই তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। তিন বছরের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন শত কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় এবং সিরাজগঞ্জে গড়ে তোলেন একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে তার নামও জড়িয়ে যায়।



সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়ার পর থেকেই জান্নাত আরা হেনরীর সম্পদ দ্রুত বাড়তে থাকে। রিকশা থেকে এক লাফে ৮৭ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্রুজারে উঠেন তিনি। ঢাকার পাশাপাশি সিরাজগঞ্জেও বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, জান্নাত আরা হেনরীর নামে রয়েছে কয়েকশ বিঘা জমি, একাধিক বাড়ি, বিলাসবহুল রিসোর্ট এবং অর্ধডজন বিলাসবহুল গাড়ি।



দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন জান্নাত আরা হেনরী। তবে ২০২৩ সালে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর তার রাজনৈতিক প্রভাব বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। সাংসদ হওয়ার তিন মাসের মাথায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে স্বামী শামীম তালুকদার লাবুকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানিয়ে আনেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ক্ষুব্ধ হন।



জান্নাত আরা হেনরীর সম্পদ বৃদ্ধির হিসাব অত্যন্ত চমকপ্রদ। ২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী তার বাৎসরিক আয় ছিল ১ লাখ ২২ হাজার টাকা, আর সম্পদের মূল্য ছিল ৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী তার সম্পদের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। সরকারি হিসাবেই তার সম্পদ বেড়েছে ৮৮৪ গুণ। এছাড়া, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুরে তিনি বিশাল সম্পত্তির মালিক। তার নামে রয়েছে ৯টি বিলাসবহুল গাড়ি এবং একাধিক বাণিজ্যিক ভবন।



জান্নাত আরা হেনরীর সম্পদের উত্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন বিতর্ক। সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য থাকাকালীন তিনি আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এই কেলেঙ্কারিতে তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তবে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ও অন্যান্য পরিচালকগণ ওই অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পান।



পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবু পলাতক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সম্পদ আত্মসাৎ করার অভিযোগে মামলা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে এবং তাদের রাজনৈতিক সহকর্মীরাও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।