‘মুনাফেকি’ কবিরা গোনাহসমূহের মধ্যে অন্যতম। কুফর, শিরক, অহংকার যেমন মারাত্মক কবিরা গোনাহ, ঠিক মুনাফেকিও তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কেননা মুনাফেকির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলাম ও মুসলমান।
এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের প্রায় মজলিসে মুনাফেকি থেকে বিরত থাকতে বলতেন। হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ বর্ণনাটিই তার অন্যতম প্রমাণ।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন উপদেশ কমই দিয়েছেন যেখানে তিনি এ কথাগুলো বলেননি। আর তাহলো
>> যার মধ্যে আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই। এবং
>> যে ওয়াদা রক্ষা করে না তার মধ্যে দ্বীন নেই।’ (আকায়েদে নাসাফি)
আর আমানতের খেয়ানত ও ওয়াদা ভঙ্গ উভয়টিই মুনাফেকি। মুনাফেকির কারণেই সমাজে সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে।
যেসব কাজের জন্য কুরআন-সুন্নাহয় জাহান্নামের ভয় ও শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে সেসব কাজই কবিরা গোনাহ। আর মুনাফেকির ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নায় সুস্পষ্ট শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
>> মুনাফিকদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম। তাও আবর শুধু জাহান্নাম নয়, তারা থাকবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। যে স্থানের শাস্তি অনেক ভয়াবহ ও মরাত্মক। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘নিঃসন্দেহে মুনাফেকরা থাকবে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তোমরা তাদের জন্য কখনও কোনো সাহায্যকারী পাবে না।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৪৫)
>> আল্লাহ তাআলা মুনাফেকদের শাস্তি দেবেন মর্মে ওয়াদাবদ্ধ। তাদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ ও স্থায়ী আজাব সুনির্ধারিত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, মুনাফেক পুরুষ আর মুনাফেক নারীদের এবং কাফেরদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। সেখানে তারা থাকবে সর্বদা। সেটাই তাদের জন্যে যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন এবং তাদের জন্যে রয়েছে স্থায়ী আজাব।’ (সুরা তাওবা : আয়াত ৬৮)
মুনাফেকি অন্যতম কবিরা গোনাহ হওয়ার কারণ হলো, মুনাফেকির মাধ্যমেই ইসলাম ও মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি গ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের জন্য জাহান্নামের সবচেয়ে নিম্নস্তরের লেলিহান শিখার শাস্তি কথা ঘোষণা করেছেন।
মুনাফিকরা ঈমান গ্রহণের ব্যাপারেও ছিল মিথ্যাবাদী। আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারায় (৮-১২) সে কথা তুলে ধরে বলেন-
০৮. আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়।
০৯. তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারগণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এতে তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না।
১০. তাদের অন্তঃকরণ ব্যধিগ্রস্ত আর আল্লাহ তাদের ব্যধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আযাব, তাদের মিথ্যাচারের দরুন।
১১. আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্ গামা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি।
১২. মনে রেখো, তারাই হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না।
১৩. আর যখন তাদেরকে বলা হয়, অন্যান্যরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরাও কি ঈমান আনব বোকাদেরই মত! মনে রেখো, প্রকৃতপক্ষে তারাই বোকা, কিন্তু তারা তা বোঝে না।
কুরআনের ভাষায় মুনাফিকরা শুধু ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গেই প্রতারণা করে থেকে থাকেনি বরং তারা আল্লাহর সঙ্গেই প্রতারণা করে। সে কথা তুলে ধরে আল্লাহ বলেন-
‘অবশ্যই মুনাফেকরা প্রতারণা করছে আল্লাহর সাথে, অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। বস্তুতঃ তারা যখন নামাযে দাঁড়ায় তখন দাঁড়ায়, একান্ত শিথিল ভাবে লোক দেখানোর জন্য। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে।’ (সুরা নেসা : আয়াত ১৪২)
তাইতো আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের মিথ্যাবাদী সাক্ষ্য দিয়ে বলেন-
‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী।’ (সুরা মুনাফিকুন : আয়াত ৬৩)
মুনাফিকদের সঙ্গে বিশ্বনবির আচরণ কেমন হবে, সে ব্যাপারেও আল্লাহ তাআলা আয়াত নাজিল করে বিশ্বনবিকে বলেন-
‘হে নবি! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জেহাদ করুন এবং তাদের সম্পর্কে কঠোর নীতি অবলম্বন করুন। আর তাদের পরিণতির হচ্ছে জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান। (সুরা তাওবাহ : আয়াত ৭৩)
সুতরাং মুমিন মুসলমানকে মুনাফেকির নিকৃষ্ট কাজগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে। হাদিসে পাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব কাজের বর্ণনা দিয়েছেন-
হজরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকে সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে উক্ত স্বভাবগুলোর কোনো একটি থাকে, তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফেকির স্বভাব থেকে যায়। আর তাহলো-
>> তার কাছে কোনো আমানত রাখলে খেয়ানত করে;
>> সে কথা বললে মিথ্যা বলে;
>> ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে;
>> ঝগড়া করলে গাল-মন্দ করে। (বুখারি, মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে মুনাফেকি কবিরা গোনাহ। এর শাস্তিও ভয়াবহ। তাই মুনাফেকি থেকে নিজেদের বিরত রাখা জরুরি।
কোনো কারণে মুনাফেকির কোনো স্বভাব বা কাজ ঘটে গেলে তা থেকে নিজেকে মুক্ত করা এবং মুনাফেকি থেকে মুক্ত থাকতে মহান আল্লাহর সাহায্য চাওয়াও জরুরি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মুনাফেকি থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।