আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে সঠিক দিকনির্দেশনার জন্য অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। প্রত্যেক নবী-রাসুলই তাদের উম্মতের সংশোধনের জন্য উত্তম চরিত্র প্রদর্শন করেছেন। এ ধারাবাহিকতায় সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র ও মহৎ গুণাবলী প্রতিষ্ঠার জন্যই সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন। আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি কোরআনুল কারিমে এভাবে তুলে ধরেছেন-
لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰهِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰهَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰهَ کَثِیۡرًا
‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ২১)
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও হাদিসে পাকে এ ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে-হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি মহৎ গুণাবলীর পূর্ণতা দিতে প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসনাদে আহমাদ, আদাবুল মুফরাদ ২৭৩)
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। কেন তিনি অনুসরণীয় আদর্শ হবেন। সে সার্টিফিকেট দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। কেননা আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে পাঠিয়েছেন। তাঁর সুমহান চরিত্রে ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে-
وَ اِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ
‘নিশ্চয়ই আপনি সচ্চরিত্রের মহান আদর্শের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত।’ (সুরা আল-কলম : আয়াত ৪)
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনে আগের সব নবী-রাসুলের যাবতীয় মহৎ গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি ছিলেন ঐশী বাণী পবিত্র আল-কোরআনেরই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বক্তব্য থেকেই তা সুস্পষ্ট।
সাহাবায়ে কেরাম উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলেন, ‘তোমরা কী কোরআন পাঠ করো না? জেনে রাখো! পুরো কোরআনই হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র। ’ অর্থাৎ তিনি ছিলেন আল-কোরআনের বাস্তব নমুনা। (মুসনাদ আহমাদ)
জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের বিধান বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। উদারতার বিরল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন এভাবে-
হজরত উকবা ইবনে আমির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তুমি তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করো। তোমার প্রতি যে জুলুম করে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে যে বঞ্চিত করে, তুমি তাকে প্রদান করো।’(মুসনাদ আহমাদ)
এই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অতুলনীয় আদর্শ। তিনি ছিলেন সততার মূর্তপ্রতীক। জীবনে কোনোদিন তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেননি। প্রতি মুহূর্তে তিনি সত্যকে লালন করেছেন। পুরো পৃথিবী যখন কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, চারদিকে জাহেলিয়াতের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল, বর্বরতার লু-হাওয়া যখন পৃথিবীকে ভারী করে তুলেছিল, এমন সময় তিনি অমানিশার অন্ধকার দূরে ঠেলে বিশ্বভুবনে সত্যের আলো জ্বেলে দিয়েছিলেন। উপাধি পেয়েছিলেন ‘আল-আমিন’। তার কাছে মানুষ তাদের মূল্যবান সম্পদ গচ্ছিত রাখত এবং গচ্ছিত রাখাকে নিরাপদ মনে করতো।
তিনি জীবনে কোনো দিন কাউকে কটুকথা বলেননি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খারাপ লোকের সঙ্গেও উত্তম আচরণ করতেন। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসার অনুমতি চাইলেন। আমি সে সময় তার কাছে বসা ছিলাম। তিনি বললেন, এ ব্যক্তি গোত্রের কতই না খারাপ লোক! এরপর তাকে আসার অনুমতি দেওয়া হলো এবং তিনি তার সঙ্গে খুবই নম্রভাবে কথা বললেন। এরপর লোকটি বের হয়ে গেলে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! তার সঙ্গে বিনম্র ব্যবহার করলেন! অথচ আপনি অন্যরকম মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বললেন, হে আয়েশা! কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে ওই ব্যক্তিই সবচেয়ে খারাপ, যাকে মানুষ তার অশালীন কথার ভয়ে ত্যাগ করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ মানুষ তো সে, যার জিহ্বার অনিষ্ট (খারাপ আচরণ) থেকে আত্মরক্ষার জন্য মানুষ তাদের সম্মান করে।’ (আদু দাউদ)
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবার সঙ্গে উত্তম আচরণ করতেন। তিনি ছিলেন ক্ষমাশীল, উদার মানসিকতার অধিকারী। তিনি কষ্টের প্রতিদান দিতেন ক্ষমা দিয়ে। মক্কা বিজয়ের ইতিহাস তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেই কাফের-মুশরিকরা প্রতি মুহূর্তে তাকে নির্যাতন করতো, দুষ্ট ছেলেদের তার পেছনে লেলিয়ে দিতো, যাদের অত্যাচারে নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে হলো, সেই কাফেরদের ওপর যখন তিনি জয়ী হলেন, কী আশ্চর্য! কোনো ধরনের শাস্তি না দিয়ে বা প্রতিশোধ না নিয়েই তিনি সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। হাদিসের বর্ণনা থেকে তা প্রমাণিত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন লোকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দানশীল। ’ (বুখারি, মুসলিম)
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কেউ কিছু চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করতেন না। কিছু থাকলে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিতেন। নতুবা পরবর্তী সময়ের জন্য ওয়াদা করতেন। অথবা তার জন্য দোয়া করতেন যেন আল্লাহ অন্যভাবে তার প্রয়োজন পূরণ করে দেন।নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবার কথা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। হাদিসে পাকে এসেছে-হজরত আমর ইবনে আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমাজের নিকৃষ্ট ব্যক্তির সঙ্গেও পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে কথা বলতেন। এমনকি আমার সঙ্গেও তিনি কথা বলতেন অনুরূপভাবে।
তাতে আমার মনে হলো, আমি সমাজের উত্তম মানুষ। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ভালো, না আবু বকর ভালো? তিনি বললেন, আবু বকর! আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ভালো, না ওমর ভালো? তিনি বললেন, ওমর! আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, আমি ভালো না উসমান? তিনি বললেন, উসমান! আমি যখন বিস্তারিতভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, তখন আমাকে সঠিক কথা বলে দিলেন। পরে আমি মনে মনে কামনা করলাম, যদি আমি তাকে এরূপ প্রশ্ন না করতাম! (শামায়েলে তিরমিজি)
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবেই প্রতিটি মানুষের সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে কথা বলতেন ও শুনতেন। উদারতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতেন। এসবই মানবজাতির জন্য বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণীয় আদর্শ।
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার খাদেমদের সঙ্গেও কখনো রূঢ় ভাষা ব্যবহার করতেন না। হজরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি ১০ বছর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমত করেছি; কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তিনি কখনো আমার কোনো কাজে ‘উফ’ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। আমি করেছি এমন কোনো কাজের ব্যাপারে তিনি কখনো জিজ্ঞাসা করেননি যে, কেন করেছি? আর না করার ব্যাপারেও তিনি কখনো জিজ্ঞাসা করেননি যে, কেন করোনি? চরিত্র-মাধুর্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি এমন কোনো রেশমি কাপড় বা কোনো বিশুদ্ধ রেশম বা অন্য কোনো নরম জিনিস স্পর্শ করিনি, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতের তালুর চেয়ে নরম। আমি এমন কোনো মিশক বা আতরের সুবাস পাইনি, যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘামের ঘ্রাণ থেকে অধিক সুগন্ধিময়।’ (শারহুস সুন্নাহ, মুসনাদ আহমাদ)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো নিজের জন্য প্রতিশোধ নিতেন না। হাদিসে এসেছে-হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কখনো নিজের জন্য প্রতিশোধ নিতে দেখিনি, যতক্ষণ না কেউ আল্লাহর নির্দেশনার সীমা লঙ্ঘন করতো। অবশ্য যখন কেউ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করতো, তখন তার মতো অধিক ক্রোধান্বিত আর কেউ হতে দেখিনি। তাকে যদি দুটি কাজের মধ্যে যেকোনো একটির অনুমতি দেওয়া হতো, তবে তিনি সহজ কাজটিই বেছে নিতেন, যদি না এটা গুনাহের কারণ হতো। (মুসনাদে আহমাদ)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলতেন, তোমরা কারও কোনো প্রয়োজন দেখলে, তা সমাধান করতে সাহায্য করবে। কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে তিনি চুপ করে থাকতেন। কেউ কথা বলতে থাকলে তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজে কথা শুরু করতেন না। অবশ্য কেউ অযথা কথা বলতে থাকলে, তাকে নিষেধ করে দিতেন। অথবা মজলিশ থেকে উঠে যেতেন, যাতে বক্তার কথা বন্ধ হয়ে যায়।’ (শারহুস সুন্নাহ)
এ ছিল মুসলিম উম্মাহর দরদী ও অনুকরণীয় আদর্শ হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এক কথায় তাঁ আদর্শ হলো অতুলনীয়। তিনি বিশ্বজাহানের তুলনাহীন আদর্শের অধিকারী। পুরো মানবজাতির জন্য তার আদর্শ অনুসরণীয়।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তার আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে জীবনের সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।