ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মূল ভূখণ্ডের সংযোগস্থল ‘চিকেনস নেক’ বা শিলিগুড়ি করিডোর। সম্প্রতি এই এলাকাকে ঘিরে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে ভারত। বিশেষ করে বিমসটেক সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর থেকেই করিডোর এলাকায় ভারতের সামরিক তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
দুইদিনের থাইল্যান্ড সফর শেষে শুক্রবার নরেন্দ্র মোদি যখন শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে ব্যাংকক ছাড়েন, তখনই ভারতের এই অঞ্চলজুড়ে নিরাপত্তা জোরদারের খবর সামনে আসে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-চীন ঘনিষ্ঠতা, ইউনূসের চীন সফর এবং সেখানে তার বক্তব্য ভারতকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের জীবনরেখা বলা হয় যেই শিলিগুড়ি করিডোরকে, সেটির সুরক্ষাই এখন দিল্লির সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার।
মোদি-ইউনূস বৈঠক: কূটনীতির ভিন্ন ইঙ্গিত
থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ৪০ মিনিটের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকটি ছিল নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর ইউনূস-মোদির এটিই ছিল প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ।
বৈঠকে সেভেন সিস্টার্স অঞ্চল, বাংলাদেশে বিনিয়োগ, চীনের প্রভাব, নিরাপত্তা ইস্যু, সীমান্ত পরিস্থিতিসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফর এবং সেখানকার বক্তব্য নিয়ে ভারত আগে থেকেই সতর্ক ছিল। তিনি চীনা বিনিয়োগের প্রসঙ্গে যেভাবে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছিলেন, তা দিল্লির কূটনৈতিক মহলে নতুন আলাপের জন্ম দেয়।
শিলিগুড়ি করিডোর: ভারতের কৌশলগত টার্গেট
শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের জন্য কেবল ভূখণ্ডগত সংযোগ নয়, এটি এক ধরনের কৌশলগত অস্তিত্বের লড়াইও। কারণ মাত্র ২২ কিলোমিটার চওড়া এই করিডোর দিয়েই ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় থাকে। চারপাশে নেপাল, বাংলাদেশ, ভুটান ও চীনের সীমান্ত হওয়ায় এই করিডোরের গুরুত্ব অপরিসীম।
ভারত মনে করছে, এই করিডোর যদি কোনওভাবে হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সেই ঝুঁকি ঠেকাতেই এবার যেন আরও কঠোর ও আধুনিক নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে ফেলা হচ্ছে এলাকাটিকে।
বহুমাত্রিক সামরিক প্রস্তুতি
ভারতের সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে করিডোর এলাকায় একের পর এক আধুনিক অস্ত্র, যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য -
→ রাফাল যুদ্ধবিমান: হাশিমারা বিমানঘাঁটিতে রাফাল যুদ্ধবিমানের একটি স্কোয়াড্রন মোতায়েন করা হয়েছে।
→ ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র: শিলিগুড়ি করিডোরে ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের একটি রেজিমেন্ট স্থাপন করা হয়েছে।
→ এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র: আকাশপথে সম্ভাব্য যেকোনো আক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে ভারত।
→ এমআরএসএএম সিস্টেম: মাঝারি দূরত্বের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে মোতায়েন করা হয়েছে এই প্রযুক্তি।
→ টি-৯০ ট্যাংক মহড়া: এলাকাজুড়ে টি-৯০ ট্যাংকসহ নানা ধরনের অস্ত্র ও সেনা সদস্যদের মহড়া চলছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর নতুন কৌশল
শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ত্রিশক্তি কর্পস মূল দায়িত্ব পালন করছে। সেনাবাহিনী বলছে, তারা এখন এই করিডোরকে ঝুঁকিপূর্ণ নয়, বরং ভারতের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিরক্ষা জোনে পরিণত করতে চায়।
সেনাপ্রধানের ভাষায় — “চিকেনস নেক আর ঝুঁকি নয়, বরং এটি ভারতের প্রতিরোধ শক্তির সবচেয়ে বড় ঘাঁটি হয়ে উঠবে।”
চীন-ঢাকা ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ
বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ, চীনা কোম্পানির প্রকল্প, সেনা সহায়তা কিংবা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নিয়ে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বিগ্ন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ড. ইউনূসের চীন সফর ও বক্তব্য দিল্লির সেই উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা যদি বেইজিংমুখী হয়, তাহলে শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তা আরও বড় চ্যালেঞ্জে পড়বে।
ভারতের পরবর্তী পদক্ষেপ কী?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের এই সামরিক তৎপরতা কেবল প্রতিরক্ষা কৌশল নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তাও। এর মাধ্যমে দিল্লি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে — শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ে কোনও ছাড় নয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণও নতুন করে নির্ধারিত হতে পারে এই ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায়।
বিশেষ করে ইউনূস-মোদি বৈঠকের পর ভারতের এই প্রস্তুতি বার্তা দেয়, দিল্লি পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। একদিকে কূটনৈতিক আলোচনার টেবিল, অন্যদিকে সেনা টহল আর যুদ্ধ প্রস্তুতি — দুই পথেই ভারত এগোচ্ছে।