বরিশালে জমি-জমা বিরোধের জের ধরে নিজের কণ্যা শিশুকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে পিতার বিরুদ্ধে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ওই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেছেন তিনি। আর আসামী করেছেন প্রতিপক্ষের ৪ শিশুকে। যাদের প্রত্যেকের বয়স ১০-১২ বছর। এদিকে মামলার সূত্র ধরে ওই চার শিশুকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত শিশুদের বুধবার দুপুরে বরিশাল সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। আদালতের জিআরও এসআই রাশেদুল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের রূনসী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
গ্রেফতারকৃত ওই চার শিশু হলো মো. সাইদুল ইসলাম (১১), মো. সোলায়মান ইসলাম তামিম (১০), মো. হাফিজুল ইসলাম লাবিব (১০) ও মো. শাওন হাওলাদার (১০)। এদের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নে রুনসি গ্রামে। এজাহারে এদের বয়স ১০ ও ১১ বছর দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনজনের বয়স ৯ বছর এবং ৯ বছর তিন মাসের মধ্যে। আর সাইদুলের বয়স দশ বছর দুইমাস বলে স্বীকার করেছেন ওসি আবুল কালাম।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গত রবিবার বিকালে সংঘটিত ওই ঘটনায় গত মঙ্গলবার রাতে নির্যাতিতার বাবা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বাকেরগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার বাদী জানান, খেলার কথা বলে গত রবিবার বিকালে ওই ৪ শিশু তার শিশু কন্যাকে ডেকে বাগানে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। পরদিন সোমবার রাতে শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়লে বিষয়টি জানতে পারেন অভিভাবকরা। পরদিন মঙ্গলবার সকালে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান তারা। বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. ইসরাত জেরিন জুঁই জানান, শিশুটির শারীরিক অবস্থা এবং ঘটনার বর্ণনা শুনে ধর্ষণের সন্দেহ হয়। পরে তাকে ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
বুধবার সন্ধ্যায় শিশুদেরকে প্রিজনভ্যানে তোলার সময়ে হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয় আদালত পাড়ায়। কথিত ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত চার শিশুর চিৎকারে প্রত্যক্ষদর্শীরাও চোখের পানি ফেলেছেন। এদিকে বৃহস্পতিবার (৮ অক্টোবর) ঘটনাস্থলে কথা হয় ওই এলাকার সংরক্ষিত আসনের ইউপি সদস্য নাজমা বেগম ও রঙ্গশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বশির উদ্দিনের সাথে। চেয়ারম্যান বশির উদ্দিন বলেন, ঘটনাটি ধর্ষণ নয়। ধর্ষণ সাজানো হয়েছে। মূলত বাদী ও বিবাদীর পরিবার আপন চাচা-ভাতিজা। উভয় পক্ষের মধ্যে ১৫ শতাংশ জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। এ নিয়ে অসংখ্যবার শালিস আমি নিজেও করেছি। পুরানো শত্রুতার জের ধরে এই মামলা।
ইউপি সদস্য নাজমা বেগম বলেন, ধর্ষণ হয়েছে বলে আমার কাছে কোন তথ্য নেই। আমি তাদের প্রতিবেশী। তাছাড়া ধর্ষণ ৪ তারিখ হলে মেয়ের গোপনাঙ্গে ৬ তারিখতো ব্যথা লাগতে পারেন না।মামলার বাদী জাহিদুর রহমান রুবেলের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে প্রতিবেশীরা বলছেন জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরেই এদেরকে ফাঁসানো হয়েছে। প্রতিবেশীরা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ধর্ষণের কোন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই। মামলার বাদী রুবেল ও গ্রেফতার হওয়া শিশুদের পিতার সাথে জমির শরিক নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছে। সে কারনে এ ধরনের মামলা হতে পারে বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বদলে ফেলেছে বাকেরগঞ্জের এই মামলাটি। তাদের মতে ১০ বছরের শিশুদের শরীরে শুক্রানু তৈরী হয় না। যাদের শরীরে শুক্রানু তৈরী হয় না তারা ধর্ষণ কিভাবে করে সেটিও প্রশ্ন।এ বিষয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডাঃ অসীম কুমার সাহা বলেন, দশ বা এগারো বছরের শিশু কখনোই ধর্ষণ করতে পারেন বলে আমার অভিজ্ঞতায় এবং চিকিৎসা শাস্ত্র পড়তে গিয়ে পাইনি। ওই শিশুর শারীরীক প্রস্তুতি ১০-১১ বছর বয়সে হয় না। আপনি যা বললেন, আমি জানি না আসলে ঘটনা কি? কিন্তু ধর্ষণের সংজ্ঞা যদি নতুন করে লেখা হয় তাহলে সম্ভব। নতুবা যৌনাঙ্গ র্স্পশ করলেই যদি ধর্ষণ হয় তাহলেও সম্ভব। কিন্তু ‘ইন্টারকোর্স’ বলতে যে বিষয় রয়েছে সেটাইতো মানবদেহে এই বয়সে সঞ্চারিত হয় না। অকল্পনীয়, অসম্ভব ব্যপার হচ্ছে শিশুরা ধর্ষণ করতে পারে বলে। খোঁজ নিয়ে দেখেন, এটা অন্য কিছু।
বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজল ঘোষ মনে করেন, একটি অসম্ভব ঘটনা হচ্ছে ১০-১১ বছরের শিশুরা ধর্ষণ করেছে। আমি মনে করি পরিণত ধর্ষকদের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন চলছে তখন কেউ কেউ ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করতে এসব অভিযোগ করছেন। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বরিশাল জেলার সদস্য সচিব ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী বলেন, আমি সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই বাকেরগঞ্জের এই ধর্ষণ মামলাটি আসলে কতটুকু সত্য তা নিয়ে আমার কাছেই সংশয় রয়েছে।
মূলত পারিবারিক বিরোধে প্রতিশোধ নিতে অনেকে আজকাল এমন অভিযোগ করে থাকেন। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে অতটুকু একটি বাচ্চা কখনো ধর্ষণ করতে পারেন না।বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কাজী আল-মামুন বলেন, যেহেতু দেশে ধর্ষণ বিরোধী একটি অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে তখন কেউ হয়তো সেটিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।বাকেরগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার জানান, ভিকটিম এবং অভিযুক্ত সবাই শিশু। তাই প্রচলিত আইনে অভিযুক্তদের বিচার হবে।