ক্লাবপাড়া ফাঁকা, সম্রাটরা গৃহবন্দী, আতঙ্কিত দুর্নীতিবাজরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: রবিবার ২২শে সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৬:৫৩ অপরাহ্ন
ক্লাবপাড়া ফাঁকা, সম্রাটরা গৃহবন্দী, আতঙ্কিত দুর্নীতিবাজরা

হঠাৎ করে অচেনা একটি ঝর এসে কেমন যেন তছনছ করে দিলো যুবলীগ ক্যাডারদের আধিপত্য। এই ঝরের কোন আচ করতে পারেননি মূলধারা কোন নেতা বা টাকার পাহাড়ে থাকা সাম্রাজ্যর সম্রাটরা। কাকরাইলের রাজমণি সিনেমা হলের সামনে ভূঁইয়া ম্যানশনে শতাধিক যুবকের পাহারা লেগেই থাকতো সব সময়। সামনে সারি সারি মোটরসাইকেল থাকতো লেগে থাকতো রাত অবধি জ্যাম। রাত যত বাড়ে, পাহারারত যুবক ও মোটরসাইকেলের সংখ্যা তত বাড়ে। এসব তরুণ–যুবকের সবাই আওয়ামী যুবলীগের কর্মী। ভূঁইয়া ম্যানশন নামের এই ভবনে বসেন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। তাঁকে আগলে রাখতেই অনুগত কর্মীদের এই সমাবেশ।

গত শুক্রবার পর্যন্ত এই ভিড় ছিল সম্রাটের কার্যালয়ে। তখনো কর্মীদের ভিড়ে জমজমাট থাকলেও মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ছিল সুনসান নীরবতা। ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে সিলগালা করে দেওয়া ক্লাবগুলোর সামনে পুলিশি পাহারা। যেসব ক্লাবে অভিযান হয়নি, সেখানেও কেউ নেই। দুই দফায় অভিযানের পর ঢাকার ক্যাসিনোগুলো বন্ধ হয়ে আছে এখন পর্যন্ত।

নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া ও ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো ছিল। এর মধ্যে ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বাকি পাঁচটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন সম্রাটের লোকজন। তবে সম্রাট নিজে সরাসরি ক্যাসিনো দেখাশোনা করতেন না। তাঁর ক্যাসিনো চালাতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তাঁরাই এক বছর আগে পল্টনের প্রীতম–জামান টাওয়ারে ক্যাসিনো চালু করেন। পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাসিনোর দুই হোতা আবু কাওসার ও মমিনুল হক ব্যক্তিগত কাজে এখন বিদেশে রয়েছেন। 

সম্রাটের বক্তব্য জানতে গতকাল ও আজ কয়েক দফা যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। কেউ তার ফোন ধরছে না। অনেকবার মুঠো ফোনে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এস এম এস করা হলেও কোন সাড়া মেলেনি। তাই আমরা তাঁর কার্যালয়ের সামনে গেলে সেখানে থাকা কর্মীরা জানান, অনুমতি ছাড়া ভেতরে যাওয়া যাবে না এবং সাংবাদিক যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। 

সম্রাটের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান জানতে গতকাল সাংবাদিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে বলেন, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপকর্মে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর নাম গণমাধ্যমে আসছে। তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না। জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘যার নাম আপনারা বলছেন, সে ছাড়াও সরকারের অন্য কেউ যদি কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ায়, তাহলে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয় গত বুধবার। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে ওই দিন মতিঝিলের ইয়ংমেনস, ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র ও বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবে অভিযান হয়। মতিঝিলে অভিযানের সময় ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদকে গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। শুক্রবার রাতে কলাবাগান ক্রীড়া চক্র ও ধানমন্ডি ক্লাবে অভিযান হয়। কলাবাগানে অভিযানের আগে ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। ধানমন্ডি ক্লাবের বার শুক্রবার সিলগালা করে দেয় র‌্যাব। আজ ও অভিযান চালান হয় মতিঝিলের আরামবাগ, দিলকুশা, মোহামেডান ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে।

গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ সভায় এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। ডিএমপি সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি বলেন, অবৈধ ক্যাসিনো পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এর হাত থেকে রক্ষা পেতে অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। যদি আমাদের পুলিশের কেউ জড়িত থাকে তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুশিয়ারী দেন সদ্য নিয়োগ পাওয়া এই কমিশনার। 

সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনিউজ৭১কে বলেছেন, জুয়া বা ক্যাসিনো বন্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। শুধু ক্যাসিনো নয়, বিভিন্ন সেক্টরে এই অভিযান চলবে। সরকারের প্রভাব খাটিয়ে যারা অন্যায় কাজে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ক্লাবপাড়ার একাধিক সূত্র বলেছে, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবও যুবলীগের প্রভাব খাটিয়ে দখল করেছিলেন খালেদ মাহমুদ। এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন। তাঁকে হটিয়ে খালেদ অনেকটা জোর করে ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে ক্যাসিনো চালাতে শুরু করেন। আর তিনি হয়ে উঠেন এই জগতের মাফিয়া। কামিয়ে নেন হাজার কোটি টাকা। তবে কি করে এতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে এসব চলতো! খালেদ সবাইকে ভাগ দিয়ে এই ব্যবসা চালাতেন নিজে জানিয়েছেন। 

এদিকে অভিযানের পর সবকটি ক্লাবই বন্ধ দেখা গেছে। ক্লাবের বেশির ভাগ কর্মকর্তা ফোন বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছেন। আবার যেসব ক্লাব খোলা ছিল, সেখানকার কর্মকর্তারা কথা বলতে চাননি। তবে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় সব নীরবতা ও হাহাকার চলছে ক্লাবগুলোতে। নেই কোন অবৈধ কোন কাজকর্ম। ক্লাবগুলোর আশে পাশের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেলো, তারাও জানতেন সব তবে ভয়ে কেউ মুখ খুলার সাহস করেননি। এবার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যখন অভিযান চলছে এবং অবৈধ এসব কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে তাই সবাই খুশি এবং সাধুবাদ দিচ্ছে।