সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছর অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণীতে পড়ার কথা ছিল কিশোরীর। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। উল্টো রুটির কারখানার এক শ্রমিকের সঙ্গে অতি সম্প্রতি তাঁকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে বয়স না হওয়ায় এ বিয়ের কাবিন করা হয়নি। মৌলবী ডেকে কলমা পড়িয়ে বিয়ের কাজ সেরে রেখেছেন; এমনটাই অকপটে বললেন কিশোরীর বাবা আক্কাস বেপারী। কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের ছোট পাঁচ নং গ্রামের ঘটনা।
একই গ্রামের আদম আলীর স্কুল পড়–য়া আরেক কিশোরীকে করোনাকালে বলিপাড়া গ্রামের শ্রমিক জুয়েল মুন্সীর সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়েছে। লেখাপড়ার পাঠ চুকে গেছে এ শিক্ষার্থীর। গ্রামটির মাদ্রাসা পড়–য়া শিক্ষার্থী রুস্তুম আলী প্যাদার কিশোরী মেয়েকেও করোনাকালে চান্দুপাড়া গ্রামের শ্রমজীবী রাকিবুলের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়েছে। একই দশা হয়েছে গ্রামের আনছার হাওলাদারের কিশোরী মেয়ের।
করোনাকালে বিয়ের ধকলে এভাবে অসংখ্য কিশোরী স্কুল পড়–য়াদের লেখাপড়ার পাঠ চুকে গেছে। শিক্ষা জীবন পরিণত হয়েছে সংসার জীবনে। এ সব কিশোরী বধূ স্বামী, সংসার কিংবা সন্তান কোনটাই ঠিক-ঠাক সামলানো দুরের কথা, বুঝতেই পারছে না। আর এর পরিনতি ঘটছে আত্মহনন কিংবা যৌতুকের বলি।
বিয়ের একমাস সাত দিন পরে নববধূ সাথী আক্তারের ঝুলন্ত লাশ কুয়াকাটা পৌর এলাকা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। ২ সেপ্টেম্বর লাশটি উদ্ধার করা হয়। এভাবে চরম পরিণতি ঘটে আরেক নববধূ সুমাইয়ার। ২৭ আগস্ট তার লাশ নয়াকাটা গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয়। বিয়ের সাত মাসেই জীবন দিতে হয় এই কিশোরীর। কিন্তু থেমে নেই বাল্যবিয়ে। তারপরও কিশোরী বধূর তকমায় যেন স্বামী-সংসারের বোঝা বইছে।
চর-চাপলী ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গাজী আলী আহম্মেদ জানান, করোনায় তার বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ছাত্রী অনুপস্থিত রয়েছে। যার মধ্যে অন্তত ৩২ জনের বিয়ে হয়েছে।
একই চিত্র মাদ্রাসার। রজপাড়া দ্বীন-ই-এলাহী দাখিল মাদ্রাসায় সম্প্রতি গিয়ে দেখা গেছে, নবম শ্রেণিতে ১১, অষ্টম শ্রেণীর ১৫ এবং দশম শ্রেণীর ১৩ জন ছাত্রী অনুপস্থিত রয়েছে। ধানখালী মহিলা মাদ্রাসায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর অনুপস্থিত রয়েছে ৬০ ছাত্রী। করোনাকালীন বাল্যবিয়ের কারণে স্কুল-মাদ্রসার ছাত্রী উপস্থিতি উদ্বেগজনকহারে কমেছে।
লালুয়ার ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সারামনি, আায়শা আক্তার ও সপ্তম শ্রেণীর জিদনী জানায়, করোনার মহামারীর কারণে স্কুল বন্ধ, তাদের অনেকের মা-বাবা কাজ কিংবা চাকরি হারিয়েছেন। ফলে অনেক পরিবারের মা-বাবা কন্যার নিরাপত্তার কথা ভেবে শিশুদের জোর করে বাল্যবিয়ে দিয়েছেন।
এছাড়া প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিপথগামী করেও এক শ্রেণীর বখাটে মেয়েদের পরিবারকে বাল্যবিয়েতে বাধ্য করেছে। তাই বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে আরও শক্ত ভূমিকা নেয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি আবেদন জানান এসব শিশু শিক্ষার্থী।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ মোখলেছুর রহমান জানান, করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষার্থী অনুপস্থিতির হার শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ। তবে মাদ্রাসায় তুলনামূলক অনুপস্থিতি বেশি। এর সঠিক কারণ জানাতে শিক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তবে তার ধারনা বাল্যবিয়ের কারণে ছাত্রী অনুপস্থিতির হার উদ্বেগজনক। কলাপাড়ায় ৩৩ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ২৭ টি মাদ্রাসার দৃশ্যপট প্রায় একই ধরনের। শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষক উপস্থিতির হারও সন্তোষজনক নয়।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদুল হক জানান, ছাত্রী উপস্থিতি কম থাকার প্রকৃত কারণ জানার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।