বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে টানা ১৪তম দিনের মতো বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে ববি শিক্ষার্থীরা। আজ মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) দুপুর ১টা থেকে ১ ঘণ্টার জন্য বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। এদিকে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবীতে আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ। অপরদিকে আন্দোলনের ১৪তম দিনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সংকট নিয়ে অবশেষে মুখ খুলেছেন উপাচার্য প্রফেসর ড. এসএম ইমামুল হক। তিনি অভিযোগ করেন, নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে সাবেক ভিসি, বহিষ্কৃত রেজিস্ট্রার, একাউন্টেন্ট ও বর্তমান ট্রেজারারসহ কিছু লোক শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলন শুধুমাত্র ভিসি’র বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বলে দাবি শিক্ষার্থীদের। এটা কারোর পক্ষে কিংবা কারোর ইন্ধনের আন্দোলন নয় বলে জানিয়েছেন তারা। এমনকি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাবার যে অভিযোগ উঠেছে তাও সত্যি নয় বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড. মাহাবুবুর হাসান।
ফলে আন্দোলন কোন দিকে মোড় নিচ্ছে এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের। তারা মনে করেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে ব্যহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। পাশাপাশি এ আন্দোলন অন্যান্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েও না আবার ছড়িয়ে পড়ে। যদিও গত ৬ এপ্রিল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা নিরসনের জন্য পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামীম এমপি, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, বরিশালের জেলা প্রশাসক এস.এম অজিয়র রহমানসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে সার্কিট হাউজে বৈঠকে মিলিত হন এবং সেখানে একটি সমঝোতাও হয়। বৈঠক শেষে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কখোনই চাইবো না বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কেউ ষড়যন্ত্র করুক।” আর বিসিসি মেয়র আশংকা প্রকাশ করে বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন যেন অন্য দিকে না যায়। তবে দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘন্টার বৈঠকের মাত্র দেড় ঘন্টার মাথায় ববি শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে পুনরায় আন্দোলনের ঘোষণা দেন।
যার ধারাবাহিকতায় আন্দোলনের ১৪তম দিনেও আজ মঙ্গলবার (৯এপ্রিল) মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নেতা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, উপাচার্য পদত্যাগ বা ছুটির লিখিত আবেদন না করলে তারা আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের একদফা দাবি আদায় না হবে ততক্ষণ তারা এই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। দুপুর ১টায় একই দাবিতে বরিশাল-কুয়াকাটা মহসড়কের কর্নকাঠী এলাকায় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। দুপুর ২টা পর্যন্ত অবরোধ চলার কারণে গুরুত্বপূর্ণ ওই মহাসড়কে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ১ ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নিলে ফের যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এদিকে শিক্ষার্থীদের এই দাবির সাথে একাত্বতা প্রকাশ করে নিজেদের ১২ দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে তারা এই সংবাদ সম্মেলন করেন। এসময় তারা সময় উপযোগী সার্ভিস রুল ও নীতিমালা সংশোধন করে পদোন্নতিসহ ১২ দফা দাবি জানান।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সংকট নিয়ে উপাচার্য প্রফেসর ড. এসএম ইমামুল হক অভিযোগ করেন, নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে সাবেক ভিসি, বহিষ্কৃত রেজিস্ট্রার, একাউন্টেন্ট ও বর্তমান ট্রেজারারসহ কিছু লোক শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। তারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অর্থের যোগান দিচ্ছেন। মূলত এ আন্দোলন নিয়ে লোক গেম হচ্ছে বলে অভিযোগ ভিসি’র। আন্দোলনের ১৪তম দিনে মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) সকালে মুঠোফোনে এ কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এসএম ইমামুল হক। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলন শুধুমাত্র ভিসি’র বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বলে দাবি শিক্ষার্থীদের। এটা কারোর পক্ষে কিংবা কারোর ইন্ধনের আন্দোলন নয় বলে জানিয়েছেন তারা। এমনকি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাবার যে অভিযোগ উঠেছে তাও সত্যি নয় বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড. মাহাবুবুর হাসান। উপাচার্য প্রফেসর ড. এসএম ইমামুল হক বলেন, ‘২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান নিয়ে যা হয়েছে তার পুরোটাই সাজানো এবং পূর্বে পরিকল্পিত। কেননা শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজনের বিষয়টিতে তারা আগেই প্রতিবাদ করতে পারতো। তা না করে প্রতিবাদ করার জন্য কেন স্বাধীনতা দিবসের দিনটিই ওরা বেছে নিলো? প্রশ্ন করেন তিনি। ভিসি বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোক। স্বাধীনতা দিবসের দিনটিতে কেউ এমন করলে সেটা নিয়ে আমার কষ্ট লাগারই কথা। যে জন্য সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কাউটের অনুষ্ঠানে এ নিয়ে দু-একটি কথা বলেছি। সেই কথার ভুল ব্যাখ্যা এবং ভিন্নভাবে প্রচার করে শিক্ষার্থীদের আমার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা হয়েছে। তার পরেও আমি শিক্ষার্থীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছি। এরপরেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কোন কারণ নেই।
প্রফেসর ড. এসএম ইমামুল হক বলেন, ‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়টি অল্প সময়ের মধ্যে সুনাম অর্জন করতে পারে। গত ৪ বছর ১০ মাসে আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনেক কিছুই করেছি। যার মধ্যে অন্যতম কাজ হলো বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্নীতি মুক্ত করা। আর এটা করতে গিয়েই আজ আমার বিরুদ্ধে এতো আন্দোলন হচ্ছে। ভিসি বলেন, ‘আমার পূর্বে যিনি ভিসি ছিলেন আমি এসে তার দুর্নীতি ও অর্থ কেলেঙ্কারি ধরে ফেলেছি। তিনি সরকারি অর্থ নিজের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে রেখে ট্রাস্টি ভবন বানিয়েছেন। অথচ ওই ভবনটি নির্মাণের পুরো ক্রেটিড তিনি নিয়েছেন। ট্রাস্টি ভবনে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবির জায়গাতে সাবেক ভিসি তার নিজির মুর্যাল তৈরি করেছেন। আমি সেটা ভেঙে দিয়েছি। তাছাড়া সাবেক ভিসি’র ৭ লাখ টাকা দুর্নীতির একটি অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে চাকরি দেয়ার কথা বলে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। আমি তাকে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় ছুটিতে পাঠিয়েছি। পরবর্তী সিন্ডিকেটের সভায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। দুর্নীতির অভিযোগে একাউন্টেন্ট বরুনকে আমি শাস্তি দিয়েছি। সে বর্তমানে সাময়িকভাবে বরখাস্ত অবস্থায় রয়েছেন।
তাছাড়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি’র পদ শূন্য। তাই ভিসি’র অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করবেন ট্রেজারার। সেই সুযোগ খুঁজছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজাররা ড. মাহাবুব হাসান। তিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার জন্য এরই মধ্যে লবিং-তদবির শুরু করে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তার মধ্যেও ট্রেজারার তার নিজ অর্থে শিক্ষার্থীদের জন্য ডাইনিং খোলা রাখেন। যা সবাই যানেন। তাছাড়া এই আন্দোলনের সাথে আরো কিছু কর্মচারীর পরোক্ষ যোগসাজস রয়েছে। যাদের নিয়োগ দিয়ে গেছেন সাবেক ভিসি। ভিসি ইমামুল হক দাবি করে বলেন, ‘ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভেবেছেন প্রধানমন্ত্রী আমাকে পুনরায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিবেন। যেটা দুর্নীতিগ্রস্ত ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাবেক ভিসি’র মধ্যে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। তারা চাচ্ছেন না আমি পুনরায় এখানকার ভিসি হয়ে আসি। এজন্যই তারা শিক্ষার্থীদের পেছনে থেকে ইন্ধন যোগাচ্ছে আন্দোলনের জন্য। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অর্থের যোগান দিচ্ছে। শুধুমাত্র কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই নন, ভিসি এসএম ইমামুল হক অভিযোগ করেছেন পুলিশের বিরুদ্ধেও। তিনি বলেন, ‘আন্দোলন বন্ধের বিষয়ে আমি পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছি। কিন্তু তারাও আমাকে কোন ধরনের সহযোগিতা করছেন না। বরং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এখন লোকাল গেম হচ্ছে। আর এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সবাই অবগত আছেন বলেও জানিয়েছেন ভিসি।
এদিকে, শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নিয়ে ভিসি যে অভিযোগ তুলেছেন তা সত্যি নয় বলে অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। স¤প্রতি বরিশাল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষার্থীরা বলেছেন, এটা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। কারোর পক্ষে বা কাউকে খুশি করার আন্দোলন নয়। আমরা আমাদের চাঁদার টাকায় আন্দোলন করছি। কারণ এটি আমাদের অস্থিত্বের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘ ভিসি ইমামুল হক একজন দুর্নীতিবাজ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি দুর্নীতির রাজত্ব গড়ে তুলেছেন। আমারা সাধারণ শিক্ষার্থীরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। এর ফলে ভিসি’র সাথে আমাদের সম্পর্কটা এমন পর্যায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে তিনি পদত্যাগ না করলে আমরা আন্দোলনকারীদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে। তাই শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা না করার জন্য অনুরোধ জানান শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মাহবুব হাসান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই। শিক্ষার্থীদের ডাইনিংএ চালু রাখার যে অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে করা হচ্ছে সেটা সত্যি নয়। তাছাড়া আমি ভিসি হওয়ার জন্যও কোন চেষ্টা করছি না। প্রধানমন্ত্রী যাকে দায়িত্ব দিবেন তিনিই ভিসি হবেন বলে জানিয়েছেন ট্রেজারার।
উলেখ্য, গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানানোয় প্রতিবাদ করলে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের কটূক্তি করেন। এর প্রতিবাদ ও বক্তব্য প্রত্যাহারসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। গত ২৯ মার্চ ভিসি তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু এতেও শিক্ষার্থীরা সন্তুষ্ট না হয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের একদফা দাবিতে টানা আন্দোলন করে আসছেন।
ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।