প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২২, ২৩:৩৮
বর্তমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাচ ভিত্তিক ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে খুলে সারাদেশ ব্যাপি বন্ধুরা একত্রে হয় বন্ধুদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রতারক ও তার সহযোগীরা অভিনব কায়দায় শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন পলাতক। প্রতারিতরা এখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন। কেউ কেউ জীবনের শেষ সম্বল হারানোর শোকে বিলাপ করছেন। প্রতারক এই চক্রটির মূল নাটের গুরু ইসমাইল হোসেন রিগ্যান।
ইসমাইল হোসেন রিগ্যান এসএসসি ২০০২ এবং এইচএসসি ২০০৪ বাংলাদেশ নামক ফেইসবুক গ্রুপের মডারেটর ছিলেন। ‘তিনি একটি সরকারি কাজ পেয়েছেন এবং তা সম্পন্ন করতে তার ১১২ কোটি টাকার প্রয়োজন।’ এই বক্তব্য দিয়ে সবাইকে সহায়তা করার অনুরোধ জানিয়ে গ্রুপে একটি পোস্ট প্রকাশ করেন গত বছর। তার সেই পোস্ট দেখে সমবয়সী এবং একই গ্রুপের সদস্য হওয়ার কারণে অনেকেই তাকে বিশ্বাস করে টাকা দেয়। প্রথম অবস্থায় সে মাসিক সুদের ভিত্তিতে কিছু মুনাফা দিলেও পরবর্তীতে সেই বিনিয়োগকারীদের আর কোন টাকা দেননি। এমন কি মূলধনও ফেরত দেননি।
ভুক্তভোগী অনেকেই রিগ্যানের দেয়া চেকের কপি নিয়ে এখন বিভিন্ন থানায় মামলা করছেন। এবিষয়ে গ্রুপের অন্য মডারেটরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রিগ্যান তার একক সিদ্ধান্তে সেই পোস্ট করেন। যেহেতু তিনি একজন মডারেটর এবং তার পোস্ট দেয়ার পূর্ব অনুমোদন ছিল, তিনি সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগান। তবে গ্রুপের সাধারণ সদস্যদের মতে এধরনের পোস্ট অনুমোদন দেয়া উচিৎ হয়নি। অনুমোদন দেয়া হলেও তা দশ দিন চলমান রাখা ঠিক হয়নি। এমনকি পরবর্তীতে গ্রুপের অন্য কোনো অ্যাডমিন বা মডারেটর এই পোস্টের আহবানে কেউ টাকা দিবেন না বলে এমন কোনো পোস্টও প্রকাশ করেনি।
গ্রুপের নামে কোম্পানি:
প্রতারক রিগ্যান ও তার কয়েকজন সহযোগী ছিলেন মডারেটর প্যানেলে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা এ বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ফেব্রয়ারি মাসে জয়েণ্ট স্টক কোম্পানিতে ‘0204 Bangladesh Ltd.’ নামে একটি কোম্পানি নিবন্ধন করে। যার রেজিস্ট্রেশন নং: C-178721, তারিখ: 15-02-2022. এই কোম্পানিতে চেয়ারম্যান হিসেবে রিগ্যান ছাড়াও, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক হিসেবে যাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন, (১) ইসমাইল হোসেন (রিগ্যান), ৯৭৪, সেভেন সারা টাওয়ার, পূর্ব নাসিরাবাদ, খুলশী, চট্টগ্রাম (চেয়ারম্যান), (২) জীবনান্দ দাস, কালিবাড়ি রোড (বোস গলি), সদরঘাট, চট্টগ্রাম, (এমডি) (৩) আতিক তৌহিদুল ইসলাম, ৩ এ/বি ১ম কলোনী, মাজার রোড, মিরপুর, ঢাকা (পরিচালক) (৪) মো. জয়নাল আবেদিন, এম/এস মা এন্টারপ্রাইজ, ৩ পলাশ নগর, মিরপুর-১১, (পরিচালক) (৫) মোবারক হোসেন সোহাগ, হাউজ নং-৮, রোড নং-৪, লেন-১, ব্লক-কে, হালিশহর, আবাসিক এলাকা, চট্টগ্রাম, (পরিচালক) (৬) মোহাম্মদ নূরুল আলম, অফিসেরচর, চৌরাপাড়া, ফতেখারকুল, রামু, কক্সবাজার (পরিচালক)।গ্রুপের ভুক্তভোগী সাধারণ সদস্যদের মতে এধরনের কোম্পানি খুলতে মডারেটর প্যানেলের অন্য কারোও কাছ থেকে তারা কোনো ধরনের অনুমতি নেয়নি। প্যানেল তাদের স্বীয় সিদ্ধান্তে এধরনের একটি কোম্পানি যাত্রা শুরু করে। সেই কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে আছে ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে পলাতক রিগ্যান। ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং অন্যান্য ডিরেক্টর হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হলো তারা সবাই গ্রুপের কয়েকজন মডারেটর।
প্রতারণার অভিনব কৌশল:
গত বছরখানেক ধরে রিগ্যানের চলন বলন এবং কাজ-কর্মে বেশ পরিবর্তন আসে। যে গাড়ির জন্য মাসিক সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ভাড়া পাওয়া যায় সেই গাড়ি রিগ্যান ৭০/৭৫ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে নিচ্ছিলেন। বেশি ভাড়া দিয়ে কৌশলে বাজারে নিজের ব্যবসার সুনাম কুড়িয়ে নেয় রিগ্যান। তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ডাক্তার, পুলিশ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অসংখ্য মানুষ তাকে মাসিকভিত্তিতে ভাড়ায় গাড়ি দিতে থাকে। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে ভাড়ার টাকা ব্যাংকে বা নগদে পেয়ে যাওয়ায় বহু গাড়ি মালিক এক বছরেও তার গাড়ির চেহারা দেখেননি। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন রিগ্যান শহরের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ১৪২টি কার ও জিপ গাড়ি নিয়ে ভাড়ায় পরিচালনা করছিলেন।
এক পর্যায়ে রিগ্যান গাড়িগুলো বিক্রি করতে শুরু করেন। এই বিক্রির ক্ষেত্রেও অভিনব প্রতারণার আশ্রয় নেয় রিগ্যান। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন স্লিপে (ব্লু বুকে) থাকা মালিকের নাম এবং ছবি ব্যবহার করে রিগ্যান নকল এনআইডি তৈরি করে। ওই এনআইডি দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পানির দামে গাড়ি বিক্রি করতে শুরু করে। মাত্র দিনদশেকের মধ্যে ৫০টিরও বেশি গাড়ি বিক্রি করে দেয় সে। একেকটি গাড়ি ৪/৫ জনের কাছে বিক্রি করার ঘটনাও ঘটেছে। একেকটি কার, মাইক্রো এবং জিপ ১২ থেকে ৩০ লাখ টাকার বিক্রি করে দিয়েছে। সস্তায় পাওয়ায় অনেকেই গাড়িগুলো কিনে নেয়। নকল এনআইডি দিয়ে তিনশ’টাকার স্ট্যাম্পে সেলরিসিট তৈরি করে গাড়িগুলো বিক্রি করে দেয়া হয়। যে সব গাড়ি একাধিক মানুষের কাছে বিক্রি করা হয়েছে সেগুলো কয়েকদিন পরে ডেলিভারি দেয়া হবে বলে জানানো হয়। ক্রেতাদের বলা হয়েছে যে, গাড়িটি এখন যার কাছে ভাড়ায় চলছে তিনি আগামী মাসে দেশে চলে যাবেন। তখন গাড়িটি আর ভাড়ায় লাগাবেন না। তিনি চলে যাওয়া পর্যন্ত গাড়িটি ওই কোম্পানিতে চালাতে হবে। ৪০ লাখ টাকার গাড়ি ৩০ লাখ টাকায়, ২০ লাখ টাকার গাড়ির ১২ লাখ টাকায় কিংবা ৫০ লাখ টাকার গাড়ি ৩০ লাখ টাকায় পেয়ে অনেকেই কয়েকদিন পর ডেলিভারি নেয়ার শর্তে গাড়ি কিনতে কোনো আপত্তি করেননি। এভাবে একেকটি গাড়ি চার-পাঁচজনের কাছে বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেয় রিগ্যান। যে সানম্যার রয়েল রিজ এ্যাপার্টমেন্টে রিগ্যান বসবাস করতেন সেই এ্যাপার্টমেন্টের অপর এক ফ্ল্যাট মালিকের একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি ৬৭ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন রিগ্যান। পরবর্তীতে ক্রেতা গাড়িটি নিতে আসলে ফ্ল্যাট মালিক আকাশ থেকে পড়েন। তিনি কোনো গাড়ি বিক্রি করেননি বলে জানালে মার্সিডিজ ক্রেতা প্রথমে হৈ চৈ শুরু করলেও পরে প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি টের পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। ৬৭ লাখ টাকা হাওয়া হয়ে যাওয়ায় তিনি চোখে মুখে অন্ধকার দেখেন।
বর্তমান অবস্থান:
শত শত মানুষের টাকা মেরে দিয়ে পরিবার পরিজনসহ রিগ্যান দুবাই পাড়ি দিয়েছে বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। প্রতারণার শিকার অসংখ্য মানুষ খুলশী থানা পুলিশের স্মরণাপন্ন হলেও দুবাই চলে যাওয়ায় রিগ্যান এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পলাতক হওয়ার পরে তার সাথে যারা সহযোগী ছিলেন তাদেরকে রিগ্যান একটি হেয়াটসআপ ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। ম্যাসেজটি আমাদের হাতে আছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমি বড়ধরনের একটা আইনগত ঝামেলায় পড়েছি। যা কল্পনাও করতে পারিনি। এজন্য আমাকে আপাতত আড়ালে থাকতে হচ্ছে। আমি ট্রেসআউট হয়ে আছি। তোরা চিন্তা করিস না তোদেরকে যেভাবে টাইম দেয়া হয়েছে আমি সেভাবেই তোদের সেটেল করবো। সময়মত তোদের সাথে যোগাযোগ করবো। দোয়া করিস’।
পুলিশ এবং স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের অলিপুর পাটোয়ারী বাড়ির জনৈক মফিজুল ইসলাম পাটোয়ারীর পুত্র মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন রিগ্যান বেশ কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম শহরে আসেন। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডর পাশাপাশি দেশি বিদেশী বড় বড় কোম্পানিকে ভাড়ায় গাড়ি দেয়ার ব্যবসা শুরু করেন। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে কার, জিপসহ বিভিন্ন গাড়ি ভাড়ায় নিয়ে সেগুলো বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ভাড়ায় লাগাতেন তিনি। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল এবং মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন প্রকল্প, অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ চট্টগ্রামে উন্নয়ন কর্মকান্ড বাড়ার সাথে সাথে রিগ্যানের ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি চট্টগ্রাম ইপিজেডের বিদেশী কোম্পানিগুলোতেও গাড়ি সাপ্লাই দিতে থাকে রিগ্যান। তার ব্যবসার পরিধি ক্রমে বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে আয়-রোজগার। রিগ্যান দক্ষিণ খুলশীর তিন নম্বর সড়কে সানম্যার রয়েল রিজ নামের অভিজাত এ্যাপার্টমেন্টে ২২৮৯ বর্গফুটের ডি-৪ ফ্ল্যাট কিনে তাতে বসবাস করতে থাকেন। দুই কোটি টাকারও বেশি দামের ফ্ল্যাটটি সাজাতে বেশ বড় অংকের টাকা ব্যয়ও করেন। পাশের ৪ নম্বর সড়কে ৫৭০ নম্বর বাড়িতে অফিস স্থাপন করেন।
গ্লোবাল কর্পোরেশন:
গ্লোবাল কর্পোরেশন নামের কোম্পানি গঠন করে ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন রিগ্যান। তার সকল প্রতারণা ও টাকা নেয়ার কৌশল তিনি গ্লোবাল কর্পোরেশন নামের কোম্পানিকে ব্যবহার করেন। সকল ডিড বা চুক্তিপত্র ডকুমেন্ট তৈরি হয় এই কোম্পানির নামে। তথ্যসূত্র বলছে গ্লোবাল কর্পোরেশন কোম্পানির অনেকগুলো সিস্টার কনসার্ন বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সিস্টার কনসার্ন কোম্পানির কয়েকটিতে তিনি সুকৌশলে তার ব্যাচভিত্তিক গ্রুপ এসএসসি ২০০২ এবং এইচএসসি ২০০৪ বাংলাদেশের অনেককেই বোর্ড অব ডিরেক্টর বানান। তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারি হিসেবে সেই গ্রুপের অনেক সমবয়সী সদস্যকে নিয়োগও দেন। গ্রুপের সাধারণ সদস্যদের মতে বোর্ড অব ডিরেক্টর বা পরিচালনা পর্ষদে যারা ছিলেন তারা নিজেরাই রিগ্যানের গ্লোবাল কর্পোরেশনের বিভিন্ন কাজে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তারাও (যারা ইনভেস্ট করেছিল) রিগ্যানকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। পুলিশ এখন হন্যে হয়ে পলাতক রিগ্যান ও তার সহযোগীদের খুঁজছে। প্রতিদিনই প্রতারিতরা থানায় ভিড় করছে। কিন্তু তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ভুক্তভোগীদের মতে রিগ্যান পালিয়ে গেলেও তার সহযোগীরা এদেশেই আছে। তাদের আইনের আওয়তায় নিয়ে আসতে পারলে সবকিছু জানা যাবে।
ভালোবাসার গ্রুপগুলোকে কাজে লাগিয়ে প্রতারক এই চক্রটি হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। কারও জায়গা, কারও চাকরি করে জমানো জীবনের শেষ সম্বল যা তারা সঞ্চয় করেছিলো বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক নিরাপত্তার জন্য, একটু ভালো থাকার জন্য। সরল বিশ্বাসে সেই সঞ্চয় তারা দিয়ে আসে বন্ধুত্বের খাতিরে প্রতারক রিগ্যান ও তার সহযোগীদের হাতে। সেই টাকা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানো রিগ্যান ও দেশে থাকা তার সহযোগী প্রতারক চক্রকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পথ চেয়ে আছে হাজারো ভুক্তভোগী।