প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৫, ১১:৫২
ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা এখন তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। অভিযোগ উঠেছে, সরকার পতনের আশঙ্কায় আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার করে তিনি নির্বিচারে গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকতের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গ্রেফতার হওয়া এই তিনজনের কাছ থেকে উদ্ধার করা মোট সাতটি মোবাইল ফোন বর্তমানে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে রয়েছে। এসব ফোনের মধ্যে রয়েছে পলকের একটি আইফোন ফিফটিন প্রো ও দুটি স্যামসাং এস টুয়েন্টিফোর আল্ট্রা, টুকুর একটি নোকিয়া বাটন ফোন ও একটি স্যামসাং গ্যালাক্সি এম ফোরটিন এবং সৈকতের একটি আইফোন ও একটি ডোকোমো ৫জি ফোনসেট।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা বারবার ফোনে যোগাযোগ করেন তার বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে। এসব ফোনালাপেই আন্দোলন দমন, ইন্টারনেট বন্ধ এবং ব্লকরেইডের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে ধারণা তদন্তকারীদের। বিশেষ করে, ইন্টারনেট শাটডাউন বাস্তবায়নে পলককে কয়েক দফা নির্দেশনা দেন তিনি। একইভাবে টুকু ও সৈকতের ফোনেও গোপন বার্তা পাঠান শেখ হাসিনা।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, আসামিরা গ্রেফতার হওয়ার আগে তাদের মোবাইল থেকে সব ধরনের ডাটা মুছে ফেলেন। হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, ভাইবারসহ বিভিন্ন অ্যাপস ডিলিট করা হয়। ফলে ফোনগুলো জব্দ করেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য উদ্ধার করা যায়নি। এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে ফোনগুলো ফরেনসিক পরীক্ষায় পাঠানো হয়, যাতে মুছে ফেলা বার্তা, ছবি, ভিডিও বা অডিও পুনরুদ্ধার করা যায়।
ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে এসব ফোন থেকে গোপন বার্তা, কথোপকথন এবং মিডিয়া ফাইল উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি ইন্সপেক্টর আব্দুল্লাহেল বাকী জানান, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ চলছে এবং রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত চার্জশিটে উল্লেখ করা হবে। তবে পরীক্ষার অগ্রগতি বা প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে এখনই কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
জুলাইয়ের ওই আন্দোলন দমনে নির্দেশনার অভিযোগের ভিত্তিতে রিকশাচালক কামাল মিয়ার হত্যাকাণ্ডের মামলার তদন্ত শুরু হয়। মামলার নথিতে উল্লেখ আছে, আসামিরা সরকার ও দলের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক এবং মাঠপর্যায়ে ক্যাডার ছিলেন। তাদের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে প্রাপ্ত তথ্য হত্যাকাণ্ডের হুকুমদাতা এবং অন্য জড়িতদের চিহ্নিত করতে সহায়ক হতে পারে।
ডিজিটাল তথ্য আদালতে প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হওয়ার বিধান ২০২২ সালের এভিডেন্স অ্যাক্টে যুক্ত হওয়ায়, এই ফরেনসিক রিপোর্ট মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটরিয়াল টিমের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজি জানান, এসব তথ্য যদি মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, তবে তা ম্যাটেরিয়াল ফ্যাক্টস হিসেবে আদালতে গৃহীত হবে।
ঘটনার সার্বিক প্রেক্ষাপটে তদন্তকারীরা মনে করছেন, শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশেই ওই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। মোবাইল ফোন ও ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তিনি কী বার্তা প্রেরণ করেছিলেন, তা প্রমাণিত হলে এই মামলার মোড় নিতে পারে ভিন্ন দিকে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়।