প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১:২৯
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল শহরের মিশন রোডের একটি তিন তলা বিশিষ্ট বিশেষ বাড়ি ছিল ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতীক। বাড়িটি হয়ে উঠেছিল সব ক্ষমতার কেন্দ্র। ঢাকা থেকে নিজ জেলায় আসলে এ বাড়িতে থাকতেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ। তার হুকুমেই চলত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক কর্মকান্ড। পেশাজীবী সংগঠনগুলোও চলত তার নির্দেশে।
বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও সংগঠনের নেতারা এখানে নিয়মিত হাজিরা দিতেন। সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রীর কথাই ছিল শেষ কথা। সরকারি জনবল নিয়োগ, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, ঠিকাদারি, প্রকল্প, সিলিকন বালু, স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন, নিয়োগ-বদলি, ভূমি লিজ বন্দোবস্তসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হতো এখান থেকেই। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন রাত্রে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পর থেকে নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর সেই আলিশান বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত পড়ে আছে।
গতকাল সরেজমিনে এ বাড়িটি ঘুরে দেখা যায় ময়লা-আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়ে নীরবে ভগ্ন অবস্থায় ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির পাশের লোকজন জানান, আব্দুস শহিদ এমপি বাড়িত থাকলে নানান লোকজন আসতেন। মধ্যরাত পর্যন্ত বাড়িটি সরগরম থাকত। বাড়ির সামনে দামি গাড়ির সারি দেখা যেত। এখন বাড়িতে কেউ নেই, লোকজনও আসে না। বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। পথচারী যাওয়ার সময় শুধু তাকিয়ে দেখে। স্থানীয়রা জানান, এ বাড়িটি আওয়ামী লীগ সরকারের ৩৩ বছরে এমপি আবদুস শহীদের ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। গত ২৯ অক্টোবর একাধিক হত্যা মামলায় ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন আব্দুস শহীদ। এ সময় তাঁর বাসা থেকে নগদ ৩ কোটি টাকা, আট দেশের বিপুল মুদ্রা ও ৮৫ ভরি স্বর্ণ জব্দ করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রী হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ শাসনামলে চিফ হুইপ থেকে বিভিন্ন পদে বসে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হন আব্দুস শহীদ। পিছিয়ে নেই তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা, এমনকি ভাইয়েরাও। ২০০৮ সালে হলফনামায় স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭০৭ টাকার সম্পদ দেখান আব্দুস শহীদ। ২০২৩ সালের হলফনামায় তা হয়েছে ৭কোটি ৪৩ লাখ ৮৮ হাজার ৯০৮ টাকা। পাঁচ বছর আগেও স্ত্রী উম্মে কুলসুমার কোনো সম্পদ ছিল না। কিন্তু ২০২৩ সালে গৃহিণী স্ত্রীর ১০০ ভরি স্বর্ণ, নগদ ৪ লাখ টাকা, বন্ড-ঋণপত্র ও শেয়ারে ১ লাখ ৩৬ হাজার এবং অকৃষি জমির পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা উল্লেখ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। স্থানীয় সূত্র জানায়, আওয়াামী লীগ সরকারের আমলে চা-বাগান প্রতিষ্ঠার নামে বন বিভাগের জমি দখল, বাগান বাড়ি নির্মাণ, হাইল-হাওরে মৎস্য খামারসহ নানাভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন আব্দুস শহীদ। চার একর জমিতে ২০১৮ সালে কমলগঞ্জের লাউয়াাছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশে ‘সাবারি টি প্লাান্টেশন’ করেন তিনি। পরে পাশে উদ্যানের ৫ একর পাহাড়ি জমি দখল করেন। হাইল-হাওর ও বাইক্কা বিলের পাশে প্রায় ২৭ বিঘা জমিতে করেছেন মৎস্য খামার।
কমলগঞ্জের কাঠালকান্দিতে ৮ একর পাহাড়ি এলাকা নিয়ে নির্মাণ করা হয় বাগান বাড়ি। এছাড়াও হাইল-হাওড়ে এবং বাইক্কা বিলের পাশে প্রায় ১১ একর জমি নিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল মৎস্য খামার। পতিত আওয়ামীরীগ সরকার পতনের পর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ৫ একর জমি গত ১৫ সেপ্টেম্বর দখলমুক্ত করার কথা জানিয়েছে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।
জানা যায়, কমলগঞ্জের মাঝেরছড়ায় কয়েক শ বিঘা টিলাজুড়ে আব্দুস শহীদের
লেবুবাগান, রাজধানীর উত্তরা ১০নং সেক্টরে ফ্ল্যাট, ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের জগদীশপুর পেট্রোল পাম্প, ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় ঘরসহ জমি ও দোকান, শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের দিলবরনগরে প্রায় ১০ একর জমিতে লেবু বাগান, শ্রীমঙ্গল শহরের কলেজ রোডে পাঁচতলা ভবন, মৌলভীবাজার সড়কে হাউজিং এস্টেটে জায়গা, কমলগঞ্জ উপজেলা সদরে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন বাড়ি। যেখানে অবৈধ গ্যাস সংযোগসহ গ্রামের বাড়িতে সরকারি খরচে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন স্থাপনা ও পুকুর খনন করেন আব্দুস শহীদ।
২০১২ সালে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি তার চাহিদানুযায়ী বিধি লঙ্ঘন করে গ্রামের বাড়িতে প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে গ্যাসলাইন স্থাপন করে দেয়। এ ছাড়া লোকমুখে প্রচলিত আছে তার নামে-বেনামে কানাডা, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। ইতোমধ্যে দুদক তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের দিনই আব্দুস শহীদের মৌলভীবাজারের রিসোর্ট, বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
শুধু সম্পদ নয়, নামেরও ‘কাঙাল’ আব্দুস শহীদ। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি অর্থায়নে একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হলেও, তাতে নামকরণ করেছেন তিনি।
শ্রীমঙ্গলে উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদ কলেজ, কমলগঞ্জ সরকারি গণমহাবিদ্যালয়, সুজা মেমোরিয়াল কলেজ শমশেরনগর, পতনঊষার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কমলগঞ্জ মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সিবাজার কালিপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবনের নামকরণ করা হয়েছে উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদের নামে।
স্থানীয়রা জানান, আব্দুস শহীদের প্রভাব দেখিয়ে তাঁর স্বজনও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পদ দীর্ঘদিন পর্যায়ক্রমে দখলে রেখেছেন তাঁর দুই ভাই অন্য ভাই ইফতেখার আহমেদ বদরুল একাধিকবার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতার দাপটে। আরেক ভাই ইমতিয়াজ আহমদ বুলবুলকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক রফিকুর রহমানের বিপরীতে বিদ্রোহী দাঁড় করিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী করেছেন।
জানা যায়, আব্দুস শহীদ নিজের, স্ত্রী ও সন্তানদের নামে শ্রীমঙ্গলের মিশন রোড, কলেজ রোড, হবিগঞ্জ রোড, মৌলভীবাজার রোড, কমলগঞ্জের উপজেলা পরিষদের সামনে, শমসের নগর বিমান বন্দরের পাশে বাসা-জমি, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আটটি অ্যাপার্টমেন্ট, লেক ও বাগান বাড়ি করেছেন। ২০০৯ সালে চিফ হুইপ হয়ে তিনি কমলগঞ্জের সিদ্ধেশ্বরপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচে গ্যাস সংযোগ নেন। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী করতে তিন ভাই ও বড় মেয়েকে দলীয় পদ-পদবি দিয়ে নিয়ে আসেন জনসম্মুখে। প্রভাব খাটিয়ে ছোট ভাই ইমতিয়াজ আহমদ বুলবুলকে কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইফতেখার আহমদ বদরুলকে রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মোসাদ্দেক আহমদ মানিককে বানান কমলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। বড় মেয়ে উম্মে ফারজানা ডায়নাকে পদ দেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদকের।
উদ্দেশ্য ছিল আগামীতে সংসদ নির্বাচনে তাকে প্রার্থী করার। এজন্য রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মেয়েকে নিজের সঙ্গেই রাখতেন আব্দুস শহীদ। এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের মাঝে অসন্তোষ ও ক্ষোভ ছিল। বলা চলে সংসদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত শহীদ পরিবারের ছিল একক আধিপত্য।
শিক্ষকতা পেশা থেকে আব্দুস শহীদ আওয়ামী লীগে যোগদানের পর ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের হুইপ, ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও ২০০৯-১৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ মৌলভীবাজার-৪ আসন থেকে টানা সাতবার এমপি নির্বাচিত হন। সর্বশেষ হাসিনা সরকারে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। মৌলভীবাজার আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সব কিছু হতো আব্দুস শহিদের মিশন রোডের বাড়ি থেকেই।
বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও সংগঠনের নেতারা নিয়মিত হাজিরা দিতেন এ বাড়িতে। বাড়িটিকে ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। তারাই আওয়ামী লীগে বড় বড় পদ-পদবি পেতেন। দলের অনেক ত্যাগী নেতারা ছিলেন কোণঠাসা। এ কারণে সে বাড়ি নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেই চাপা অসন্তোষ ছিল, যদিও ভয়ে কেউ মুখ খুলত না।
মৌলভীবাজার-৪ আসনে বিএনপি থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ ও তার দোসরা আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় প্রায় ৭৬টি মামলা দিয়েছে।
অনেক মামলায় কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গলের নেতাকর্মীদের আসামি করেছে। পুলিশ দিয়ে আমাকে ও নেতাকর্মীদের নির্যাতন করিয়েছে। নির্বাচনী এলাকার জনগণের পাশে, নিজ বাড়িতে, সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠানে, এমনকি ঈদেও আমাকে এলাকায় আসতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের হয়রানি,গ্রেপ্তার আতঙ্কÑ এসবের মধ্য দিয়েও দলের কার্যক্রম চালাতে হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘ ৩৩ বছর এমপি ও মন্ত্রী থাকার পরও নিজ নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজার-৪ আসনের দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন কাজ করেনি আব্দুস শহীদ।
সাবেক মন্ত্রী কর্তৃক অবৈধভাবে গড়ে তোলা বাসা-বাড়ি, সকল প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও সম্পদ উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।