প্রকাশ: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৪
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) বরিশালে প্রতিষ্ঠার প্রায় ৫০ বছরেও নানান সংকট থাকায় উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানার মালিকগণ বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে যখন একের পর এক শিল্পকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে ঠিক সেই মুহুর্তে এখানে শিল্পকারখানা গড়ে তোলে ফরচুন সুজ প্রাইভেট কোম্পানী নামের একটি প্রতিষ্ঠান। দক্ষ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মিজানুর রহমান অল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের রপ্তানীমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ তিনে স্থান করে নেয় ফরচুন সুজ কোম্পানী।
সম্পূর্ণ রপ্তানমুখী এ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে স্পেন, জার্মানী, ভারত, ইতালী, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে তাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানী করছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের অবহেলিত নারী ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু শিল্প পুরস্কারে ১ম স্থান অর্জন করেছে “ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানী লিমিটেড”। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, তিনি নিজে কিংবা তার প্রতিষ্ঠান নয়, দেশ ও দেশের জনগণকে নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে চান। সেলক্ষ্যে ভবিষ্যতে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে “ফরচুন” ব্র্যান্ডের জুতা বাজারজাতকরণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানী লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৪ মার্চ বরিশাল শিল্প নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় “ফরচুন সুজ লিমিটেড” নামের প্রাইভেট কোম্পানীটি। মাত্র ৪৭২ জন জনবল নিয়ে জুতা তৈরীর কারখানাটি চালু হয় ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আর দক্ষ শ্রমিকের অভাব থাকলেও ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্য পশ্চিমা দেশগুলোতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যার ধারাবাহিকতায় সম্পূর্ণ রপ্তানী নির্ভর এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারী পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীতে রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে “ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানী লিমিটেড” এর আরও চারটি প্রোডাকশন লাইন (প্রিমিয়ার ফটওয়্যার লিঃ, এম.জে ইন্ডাষ্ট্রিজ, ইউনিওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যার এন্ড টেকনোলোজি লিঃ এবং ফেন-এন ফুটওয়্যার লিঃ) সংযুক্ত করে এখন ৫টি কারখানায় বরিশালে তাদের পণ্য উৎপাদন করছে।
প্রায় ১০ বছর হতে চললো, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন ইউরোপের বাজারে বেশ চাহিদা করে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্য। স্পেন, জার্মানী, ভারত, ইতালী, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ফরচুন এর উৎপাদিত পণ্য রপ্তানী করায় একদিকে যেমন দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, অন্যদিকে স্বাবলম্বী হচ্ছেন বরিশাল অঞ্চলের অবহেলিত-নির্যাতিত নারীরা। এখানে কর্মরত সাড়ে ৪ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৮০ ভাগই নারী।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মহামারী করোনাকালীন সময়ে ঝকঝকে পরিবেশে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করছেন শ্রমিকরা। কারখানার বাহিরে শ্রমিকদের হাতধোয়ার পাশাপাশি প্রতিদিনই কাজে যোগদানের সময় তাদেরকে মাস্ক দেয়া হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়। শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অভিজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তাদেরকে কাউন্সিলিং করানো হয়। শ্রমিকদের সহজে চলাচলের জন্য প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ বাস সেবা দিচ্ছে। বাসগুলো সকালে তাদের উপজেলা থেকে কারখানায় নিয়ে আসে এবং সন্ধ্যায় কাজ শেষে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়।
বিসিক শিল্প নগরী সূত্রে জানা গেছে, বিসিক শিল্প নগরীর ৬০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বরিশালে উৎপাদিত পণ্য বিশ্ববাজারে ঠাঁই করে নিয়েছে। শুধু বাজার দখলই নয় ইউরোড আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে এখানে উৎপাদিত উন্নত মানের এসব জুতার বেশ চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। এ প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় ক্রেতা পাশর্^বর্তী দেশ ভারত। অবশ্য এ কারখানায় উৎপাদিত জুতার কাঁচামালও আমদানি করতে হচ্ছে চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও প্রতিবেশী ভারত থেকে।
সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিসিক শিল্প নগরীতে চালু থাকা শিল্প কলকারখানাগুলোর মধ্যে বেঙ্গল বিস্কুট লিঃ, মোহাম্মদী ইলেকট্রিক প্রজেক্ট, সুগন্ধা ফ্লাওয়ার মিলস, বরিশাল আয়রন মিলসহ অন্য শিল্প ইউনিটগুলোও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। শুধুমাত্র ফরচুন সুজ লিমিটেড দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে তৈরীকৃত পণ্য পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রসহ মোট ৩০টি রাষ্ট্রে রপ্তানী করা হয়। এদিকে ২৭ একর জমি দখলে থাকা খান সন্স টেক্সটাইল মিলস গত দুই বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ জমি খালি করছেন না। অথচ এ মিলের চারপাশে বেষ্টনী থাকায় দেশের নামকরা একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে বিসিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রেদওয়ান বলেন, তাদের কোম্পানীর তৈরী জুতার আকৃতি, গঠন ও গুণগত মান দেশের অন্য যে কোন ব্র্যান্ডের জুতার চেয়ে উন্নত। ফরচুন পণ্য তৈরিতে ক্রেতা সন্তুষ্টির বিষয়ে কখনোই কোনো আপস করে না। ফরচুন বিশ্বের বিখ্যাত ব্রান্ডের জন্য স্যু’জ তৈরি করে থাকে। এর মধ্যে DIECHMANN, FILA, SLAZENGER, CCC, GEMO, MARKEL, UMBRO, AIRNESS, STEVE MADDEN, EURO SHOES, DUNLOP, REDTAPE, LIDL, BOND STREET, CORTINAGesPRIMARK ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি হচ্ছে ফরচুনের কারখানায়। ফরচুন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রফতানির জন্য নারী, পুরুষ, ও শিশুদের জন্য বিভিন্ন স্টাইলের স্যু’জ, ফ্যশন্যাবল স্যু’জ ও স্পোর্টস স্যুজ উৎপাদন করে থাকে। নিজস্ব ল্যাব সেকশনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এ জুতাগুলো বর্হিবিশে^ রপ্তানী করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং ব্যবস্থাকে আরো বিস্তৃৃত করতে চীনের গুংঝুয়ান শহরে রয়েছে একটি কার্যালয়। সেখান থেকেই পুরো ইউরোপে এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরবরাহ ও বিক্রি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান তার দূরদর্শীতায় ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানীকে পরিবেশ বান্ধব কোম্পানি হিসেবে গড়ে তুলেছেন এবং ফরচুনকে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কোম্পানি হিসেবে রূপান্তর করেছেন। ইতোমধ্যে কোম্পানীর চেয়ারম্যান ২০১৮ সালে দেশে শ্রেষ্ঠ তরুন শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের ‘এশিয়ার সেরা ২০০ আন্ডার এ বিলিয়ন’ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় দেশের শীর্ষ তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বরিশালের ফরচুন স্যুজ এর নাম এসেছে। অন্য দুই প্রতিষ্ঠান হলো স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যাল। এছাড়া চলতি বছর “বঙ্গবন্ধু শিল্প পুরস্কার” এ প্রথম হয়েছেন চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।
তিনি আরো বলেন, বরিশাল একটি বিভাগীয় শহর হলেও এখানে ইপিপি বা কাস্টমস্ অফিস নেই। তাছাড়া বিসিক শিল্প নগরী বিশাল পরিধি থাকলেও এখানে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত ব্যবস্থা, শিল্প পুলিশ বা সীমানা প্রাচীর নেই। এজন্য এখানে বিদ্যুতের আলাদা সাব স্টেশন, শিল্প পুলিশ ইউনিট এখনকার সময়ের দাবী। তাছাড়া পণ্য আনা নেয়ার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই লেনের সড়ক ব্যবস্থা থাকা দরকার। তবে আগামী মাসে লেবুখালী সেতু চালু হলে পায়রা বন্দরের সাথে যোগাযোগ সহজ হবে এবং পদ্মা সেতু চালু হলে আমদানী রপ্তানী কার্যক্রম আরো বেগবান হবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি জানান, ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানী শুধুমাত্র ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোন নিয়েই নয়, তারা দেশের তরুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্ণী প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। চলতি বছর বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ১৯ জন শিক্ষার্থীকে তারা ইন্টার্ণী প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এছাড়া এ অঞ্চলের অসহায় দরিদ্র মানুষকে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৪৯ লাখ টাকা ব্যয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মহামারী করোনাকালীন সময়ে র্যাব, পুলিশ ও বিভাগীয় কমিশনারকে সহায়তা করেছেন। পাশাপাশি করোনায় কর্মহীন দরিদ্র মানুষকে সহায়তা হিসেবে সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন তারা।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের প্লেয়ারদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার সুযোগ সৃষ্টির জন্য বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের বড় আসর আইপিএল-এ “ফরচুন বরিশাল” নামের দলটি কিনে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।
ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানীর চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, তার জন্মস্থান বরিশাল হওয়ায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীতে কারখানা স্থাপন করেছেন তিনি। অবহেলিত এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করতেই নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তিনি বরিশালেই কারখানা গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, নিজে কিংবা তার প্রতিষ্ঠান নয়, দেশ ও দেশের জনগণকে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের অবহেলিত মানুষকে নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে চান।