স্মার্ট কৃষি খামারে আলোড়ন তুললেন বরিশালের সুমন

নিজস্ব প্রতিবেদক
এইচ.এম.এ রাতুল, জেলা প্রতিনিধি, বরিশাল।
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ৩রা জানুয়ারী ২০২৩ ০৬:৩৯ অপরাহ্ন
স্মার্ট কৃষি খামারে আলোড়ন তুললেন বরিশালের সুমন

বরিশালের বাবুগঞ্জে পেঁপে চাষে বিপ্লবের পর এবার বাণিজ্যিকভাবে স্মার্ট কৃষি খামার গড়ে আলোড়ন তুললেন আবু বকর সিদ্দিকী সুমন। উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের বায়লাখালি গ্রামে দেড় একর জমিতে দুইটি ঘের কেটে মাছ চাষের পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন স্মার্ট কৃষি খামার। গত বছর তিনি উন্নত জাতের পেঁপে চাষ করে বরিশাল জেলায় চমক দেখিয়েছেন। এবার ওই ঘেরের চার পাশে বানিজ্যিক ভাবে আগাম ব্লাক ডায়মন্ড জাতের কুমড়া ও লাউ চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি চাষ করেছেন সিম। 


ইতিমধ্যে তিনি লক্ষাধীক টাকার কুমড়া ও লাউ বিক্রি করেছেন। তাঁর ঘেরে ২শতাধীক কুমড়া ও শতাধীক লাউ গাছ রয়েছে। প্রতি মন কুমড়া গড়ে ৯০০-১২০০টাকা দরে বিক্রি করেছেন। প্রতি পিচ লাউ আকার ভেদে ৫০-১০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন।  গত দুই বছরে কৃষিতে সফল হওয়ায় তিনি ইউনাইটেড সীড ও এগ্রিকালচার রিচার্স সেন্টার থেকে দুইটি সম্মাননা পদক পেয়েছেন। সম্প্রতি বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. হারুন অর রশিদ ও উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা তাঁর ঘের পরিদর্শন করে প্রশংসা করেছেন। 


বাবুগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাহ্ মো. আরিফুল ইসলাম জানান, আবু বকর সিদ্দিকীর কৃষিতে অভাবনীয় সফলতার পিছনের রহস্য হচ্ছে তার প্রবল ইচ্ছে ও শ্রম বিনিয়োগ। প্রথমে তিনি ভালো জাতের বীজ সংগ্রহ করে চারা উৎপাদন করেন। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারনে তাঁর সফলতা আকাশ ছোয়া। আমরা সর্বদা তাকে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে আসছি। 


বাবুগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মামুনুর রহমান বলেন, নিয়মিত কৃষি অফিস থেকে আবু বকর সিদ্দিকির কৃষি ফার্ম পরিদর্শন করে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।  স্মার্ট কৃষি করে তিনি লাভবান হয়েছেন। উপজেলার কৃষকরা তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী কৃষি সম্প্রসারণ বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছি। 


বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. হারুন অর রশিদ বলেন, আবু বকর সিদ্দিকী সুমন বাণিজ্যিকভাবে কৃষি করে লাভবান হচ্ছে। তার কৃষির ধরনকেই স্মার্ট কৃষি বলে। সরকারের যুগোপযোগী পদক্ষেপের ফলে গত এক দশকে কৃষি ক্ষেত্রে ও খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আবু বকর সিদ্দিকী সুমন কৃষকদের আইডল হতে পারে। তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে অনেকই কৃষি কাজে আগ্রহী হচ্ছেন। 


জানাযায়, ১৯৯৩ ইং সালে আবু বকর সিদ্দিকী সুমন সাউথ আফ্রিকায় হুন্দাই কম্পানিতে একজন পেইন্টার হিসাবে যোগদান করেন। কাজের সুবাদে তিনি ২২ টি দেশ ভ্রমণ করেন। জিম্বাবুয়ে ও মালাইও ভ্রমন করতে গিয়ে সেখানে কৃষকদের পেঁপে চাষ দেখে আগ্রহী হন। তার উপার্জিত টাকায় দেশে জমি ক্রয় করেন এবং সাউথ আফ্রিকায় একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান খোলেন। ২০১৪ সালে তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে (ডাকাতি) রোবারি হয়। তখন তিনি আর্থিক ভাবে ভেঙে পরেন।


এক পর্যায় শুভাকাক্ষীদের সহযোগিতা নিয়ে আবারো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান এবং সকল দেনা পাওনা পরিশোধ করেন। স্ত্রীর কিডনি রোগের কারনে ২০২০ সালে দেশে চলে এসে চিকিৎসা করাতে থাকেন। ওই সময় আবারো তিনি অর্থনৈতিক সংকটে পরেন। ২০২১ সালে আবু বকর সিদ্দিকী সুমন মাছ চাষের উপর লোনের জন্য বাবুগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান এবং লোনের আবেদন করেন। তৎকালীন সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান আবু বকরের কথা শুনে মাছ চাষ ও পাশাপাশি সবজি চাষের পরামর্শ দেন। তখন মৎস্য অফিস থেকে একটি প্রল্পপ বাবদ ৫০ হাজার টাকা দেয়। ওই টাকায় নিজের জমিতে ঘের করে মাছ চাষ ও পেঁপে চাষ শুরু করেন। প্রথম বার জাত নির্বাচনে ভুল হওয়ায় পেঁপে চাষে ব্যর্থ হয়।


এরই মধ্যে ২১ সালের শেষের দিকে তার স্ত্রী কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি স্ত্রীর একটি গহনা ৬৬ হাজার টাকায় বিক্রি করে গাজীপুর থেকে পেঁপের ভালো বীজ সংগ্রহ করেন। বীজ থেকে চারা উৎপাদন করেন। উৎপাদিত চারা নিজের ঘেরের পারে লাগিয়ে সফল হন। ২০২২ সালে শুধু চারা বিক্রি করে তিনি ৬ লাখ টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হয়। আবু বকর সিদ্দিকী সুমন বলেন, আমার আজকের সফলতার বীজটা বপন করেছিলেন তৎকালীন সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান । তার পরামর্শে ও অনুপ্রেরণায় আমি হাল ছাড়িনি।


সুমন বলেন, উপজেলা কৃষি অফিস থেকে আমাকে বিভিন্ন সময় পরামর্শ দিয়ে সহযোগীতা করেছে। আমি এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পেঁপে চাষের উপর লেকচার দিতে আমন্ত্রণ পেয়ে থাকি। মাকড়সা ও ছত্রাক ছাড়া পেঁপে বাগানে তেমন কোনো সমস্যা দেখা যায় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে পুষ্টিমানসমৃদ্ধ পেঁপে চাষে ভাগ্য বদলে ফেলা যায়। পেঁপে চাষে অর্থনৈতিকভাবে সরকারি সহযোগিতা পেলে দেশের অনেক বেকার সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এবার সম্মিলিত কৃষি করে সফল হয়েছি। ঘেরের চারপাশে ব্লাক ডায়মন্ড জাতের কুমড়া ও লাউ চাষ করে সফল হয়েছি। তিনি মনে করেন, শিক্ষিত বেকার যুবকরা যদি চাষে অগ্রসর হয় তাহলে তারাও লাভবান হবে।