আর মাত্র ৭ দিন বাকি। ২৬ জুন উন্মুক্ত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য আর কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জেলা ঝালকাঠির পেয়ারা আর আমড়া সারাদেশে পরিচিতি লাভ করলেও এবার আর ইন্টারনেট নয়। সরাসরি পদ্মা পাড়ি দিয়ে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে ঝালকাঠির পেয়ারা, আমড়া। সঙ্গে শীতল পাটি। এ কারণে উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠিতে বইছে আনন্দ। জেলার সর্বস্তরের মানুষ আশা করছেন, পদ্মা সেতু চালুর পর ব্যবসা-বণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এতে ভীষণ খুশি কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, ঝালকাঠি থেকে ঢাকা যেতে আগে সময় লাগত ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর লাগবে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা। ঝালকাঠির পেয়ারা, আমড়া ও শীতল পাটি এত দিন নদীপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। আর ঢাকাসহ অন্য জেলা থেকে এই জেলায় বেশির ভাগ পণ্য আসত এই নদীপথেই। ফেরিতে আটকে পড়ে পণ্য পচে যাওয়াসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় এত দিন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল দীর্ঘ সময়ের। পদ্মা সেতু চালুর পর এসব প্রতিবন্ধকতার অবসান হবে।
জানা গেছে, ঝালকাঠিতে ৫০০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় পেয়ারা। সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদাসকাঠি, খাজুরা, মিরাকাঠি, ডুমুরিয়া, জগদিশপুর, খোদ্রপাড়া, পোষণ্ডা, হিমানন্দকাঠি, বেতরা, কাপড়কাঠিসহ ২০টি গ্রামে রয়েছে দেশের বৃহত্তম পেয়ারা বাগান। প্রতি বছর এসব বাগানে পাঁচ কোটি টাকার পেয়ারা উৎপাদিত হয়। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এত দিন প্রতি মণ পেয়ারা মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করা হতো। চাষিরা মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে এত দিন যাত্রীবাহী লঞ্চে রাজধানীতে পাঠাতেন পেয়ারা। এতে একদিকে সময় যেমন বেশি লাগত, অপরদিকে তরতাজা ফলটি অনেক সময় পেকে যেত। এতে বিক্রেতারা পড়তেন বিপাকে। পদ্মা সেতু চালুর পর চাষিরা দ্রুত সড়কপথে পণ্যটি রাজধানীতে পৌঁছাতে পারবেন। সড়কপথে খরচও হবে কম। এতে লাভবান হবেন চাষিরা।
ঝালকাঠি জেলার আরেকটি ফল আমড়া। লাভজনক হওয়ায় ঝালকাঠিতে কৃষকরা ঝুঁকছেন আমড়া চাষে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রতি বছর চাষিরা অন্তত ২৫ কোটি টাকার আমড়া বিক্রি করেন। এ কারণে ঝালকাঠিতে দিন দিন আমড়ার চাষ প্রসার লাভ করছে। এত দিন যাত্রীবাহী লঞ্চে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো ফলটি। এতে চাষিরা প্রত্যাশিত লাভ পেতেন না। পদ্মা সেতু চালুর পর তুলনামূলক কম খরচে এবং অল্প সময়ের মধ্যে রাজধানীতে পৌঁছানো যাবে আমড়া। চাষিরা নিজেরাই তা পৌঁছাতে পারবেন। প্রয়োজন হবে না আর মধ্যস্বত্বভোগীর।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, ঝালকাঠি জেলায় ৬৫০ হেক্টর জমিতে ১৫ হাজার ৪৭০ জন কৃষক আমড়ার চাষ করেন। এখান থেকে বছরে ৯ হাজার ১০০ টন আমড়ার ফলন পাওয়া যায়। ফলটি থেকে কৃষক যে ২৫ কোটি টাকা আয় করছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে।
এছাড়া ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি, ডহরশংকর ও গোপালপুর এবং নলছিটি উপজেলার কামদেবপুর গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার শীতল পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করে। এই গ্রামগুলোকে ‘শীতল পাটির’ গ্রামও বলা হয়। এখানকার শত শত হেক্টর জমিতে রয়েছে পাইত্র্যা গাছের বাগান। বছরজুড়ে এই গ্রামগুলোয় শীতল পাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি তৈরি করা হয়। প্রতিটি পাটি বিক্রি করা হয় ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে (বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস) প্রচুর শীতল পাটি বিক্রি হয়। এই জেলায় তৈরি শীতল পাটি থেকে বছরে আয় ১০ লাখ টাকা। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই শীতল পাটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এত দিন কারিগররা পণ্যটি পাইকারি বিক্রি করে দিতেন। এতে লাভ হতো কম। পদ্মা সেতু চালুর পর কারিগররা সরাসরি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্যটি পৌঁছে দিতে পারবেন। এতে তাদের উৎপাদন আগের চেয়ে বেড়ে যাবে এবং দামও বেশি পাবেন।
সদর উপজেলার ভিমরুলী পেয়ারা বাগানের মালিক ভবেন্দ্র নাথ হাওলাদার বলেন, ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা, নবগ্রাম, গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষ পেয়ারা ও আমড়ার চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। পদ্মা সেতু চালুর পর এই তিন ইউনিয়নের পেয়ারা ও আমড়াচাষিরা ন্যায্যমূল্য পাবেন। বাগান থেকে প্রতিদিন সকালে পেয়ারা ও আমড়া সংগ্রহ করে দুপুরের মধ্যেই ট্রাকযোগে ঢাকায় পৌঁছে দিতে পারবেন। ক্রেতারাও পাবেন সতেজ পেয়ারা ও আমড়া। আর প্রতি বছর ঝালকাঠি সদরের ভিমরুলী খালে ভাসমান পেয়ারার বাজার এবং পেয়ারা বাগান দেখতে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। পদ্মা সেতু চালুর পর এই পর্যটকের সংখ্যা আরো বহু গুণ বেড়ে যাবে।
ডুমুরিয়া গ্রামের আমড়াচাষি সুনীল হালদার বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকরা প্রচুর আমড়া চাষ করেন। পদ্মা সেতু চালুর পর আমড়া চাষের সঙ্গে জড়িতরা আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হবেন। রাজাপুর উপজেলার ডহরশংকর গ্রামের অসীম চন্দ্র দে (৩৭) বলেন, ‘শীতল পাটি তৈরির পর পাইকারদের কাছে বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার চলে আমাদের। পদ্মা সেতু চালুর পর নিজেরাই ঢাকায় নিয়ে পাটি বিক্রি করতে পারব। পদ্মা সেতু নির্মাণ করায় আমাদের ব্যবসা প্রসারিত হবে। আমাদের আর না খেয়ে থাকতে হবে না।
ঝালকাঠি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মনিরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ঝালকাঠি জেলার ব্যবসায়ীদের জন্য পদ্মা সেতু আশীর্বাদ। পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ দূরত্ব কমবে ৯০ কিলোমিটার। সময়ও কমবে কয়েক ঘণ্টা। ঝালকাঠির ব্যবসায়ীরা এতে বেশ উপকৃত হবেন। ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক জোহর আলী বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। ঝালকাঠি থেকে আমরা অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে পারব। মানুষের দীর্ঘদিনের একটি চাওয়া পূরণ হতে চলেছে। ফলে এই এলাকার কৃষিপণ্য সহজে ঢাকায় পৌঁছে যাবে। এ অঞ্চলে শিল্প-কলকারখানা বাড়বে। সব শ্রেণির মানুষের উপকার হবে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।