কুমিল্লা- ৪: দেবীদ্বারে যেসব কারনে নৌকার ভরাডুবি !

নিজস্ব প্রতিবেদক
শফিউল আলম রাজীব, উপজেলা প্রতিনিধি - দেবীদ্বার, কুমিল্লা
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ১১ই জানুয়ারী ২০২৪ ০৯:০৭ অপরাহ্ন
কুমিল্লা- ৪: দেবীদ্বারে যেসব কারনে নৌকার ভরাডুবি !

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৪ দেবীদ্বার আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত ‘নৗকা’র প্রার্থী ছিলেন রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। তিনি টানা দুইবারের সাংসদ ও এবার নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হওয়ার সত্বেও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ঈগল' প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে ভোট যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। তার পরাজয়ের পেছনে যেসব কারণগুলো ইতিমধ্যে আলোচনায় এসেছে।


এ আসনে তার নেতা কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, নির্বাচনী এলাকায় কম আসা, জ্যেষ্ঠ নেতাদের অবমূল্যায়ন, নির্দিষ্ট সংখ্যক তরুন ও যুবদের প্রাধাণ্য দেয়া এবং নিজ দলের নেতা আওয়ামীলীগ কুমিল্লা উত্তর জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক ও সদ্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগী আবুল কালাম আজাদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায়, এ আসনে আওয়ামী লীগের ‘নৌকা” প্রতীকের প্রার্থী হেরেছেন বলে মনে করছেন রাজনীতিক বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মী ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে ২ নৌকার সমর্থক বলেন, আমরা প্রশাসনের উপর নির্ভর না থেকে বিকল্প পথে এগুলেও এ ভরাডুবি হয়না।


আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সাবেক উপমন্ত্রী ও কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ এফ এম ফখরুল ইসলাম মূন্সীর দ্বিতীয় পুত্র রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। এছাড়াও রাজী ফখরুল পাকিস্তান আমলের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মফিজ উদ্দিন আহমেদের দৌহিত্র ও সাবেক মন্ত্রী ও এ আসনের এমপি এবিএম গোলাম মোস্তফার নাতী এবং এ আসনের বিএনপি দলীয় ৪ বারের সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মূন্সীর ভাতিজা।


বর্নাঢ্য রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসা রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র পদে নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে এ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র ও ২০১৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়ে। তিনি এলাকার সাধারন ভোটার এবং মুরুব্বীদের চেয়ে তরুণ ও উঠতি বয়সী বিতর্কিতদের প্রাধান্য দেন। এসব তরুণদের বেশির ভাগই ঠিকাদারী, জবরদস্তি, চাঁদাবাজীসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। মাদকের বাহিরে ড্রেজার ব্যবসা, বিদ্যুৎ মিটার সংযোগে সীমাহীন চাঁদা আদায়, সিএনজি ষ্ট্যান্ডের চাঁদাবাজী, মাত্রাতিরিক্ত জিবি আদায়, কথায় কথায় সিএনজি চালকদের নির্যাতন, ফুটপাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা আদায়সহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে সাধারন মানুষের মধ্যে বিরোপ প্রতিক্রীয়ায় পরিবর্তনের জোয়ার সৃষ্টি হয়।


সাধারন ভোটারগন রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের পরাজয়ের অন্যতম কারন হিসেবে দেখছেন, সিএনজি ষ্ট্যান্ড’র চাঁদাবাজিকে। দেবীদ্বারের জিবির নামে চাঁদাবাজির অত্যাচারে পার্শ্ববর্তী উপজেলার কোন সিএনজি- অটোরিক্সা দেবীদ্বারে আসা বন্ধ করে দেন। ফলে জরুরী রোগীসহ নানা কাজে দেবীদ্বার আসা যাত্রীরা সংকটে পড়েন। নবনির্বাচিত এমপি আবুল কালাম আজাদ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে থাকা অবস্থায় উপজেলার প্রায় ৫ হাজার সিএনজি, অটোরিক্সা চালকদের জিবি মুক্ত করতে ১৫ ইউনিয়নের সিএনজি ষ্ট্যান্ড ইজারা বন্ধ করলেও পৌরসভার ইজারা বন্ধ করতে পারেনি। সকল ইউপির সিএনজি- অটোরিক্সা পৌরসভা অভিমূখী হলে জিবির নামে চাঁদাবাজদের দৌরাত্মে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। নির্বাচণী ইসতেহারে আবুল কালাম আজাদ পৌরসভাকেও জিবি মুক্ত করার ঘোষণা দিলে সকল সিএনজি- অটো চালকরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারনা শুরু করে, চালকরা তাদের যাত্রীদেরও ‘ঈগল’ প্রতীকে ভোট দেয়ার আহবান জানায়। নির্বাচনে নৌকা পরাজয়ের এটি অন্যতম কারন হিসেবে দেখছেন সাধারন ভোটাররা।


এসব যুব তরুনদের অর্থ উপার্জনে নীতিগত কোন অবস্থান ছাড়া অনেকেই শূন্য থেকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যায়। এসব বিষয়গুলো আমলে নিয়ে প্রতিকারে কোন ব্যবস্থা নেয়নি সাবেক সাংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। তা ছাড়া এসকল কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতায় ইউপি নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীদের বাহিরে রেখে অধিকাংশ অযোগ্য প্রার্থীদের নৌকার মনোনয়ন দেয়া হয়, যাদের বেশির ভাগ প্রার্থী পরাজিত হন। গত উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বাহিরে যেয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে তিনি তাঁর চাচা কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ এফ এম তারেক মুন্সীর পক্ষে অবস্থান নেন। রাজীর অনুসারীরা প্রকাশ্যে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেন। যার কারনে প্রতিপক্ষের লোকজন রাজী ফখরুল ও তার সমর্থকদের ‘জয়বাংলা-ধানের শীষ’ নামে আখ্যায়িত করেন।


এ ছাড়াও গত বছর অনুষ্ঠিত দেবীদ্বার পৌরসভা নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে তরুণ একজনকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হন জ্যেষ্ঠ নেতারা। তার ওপর রাজী ফখরুলের বাবা আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মন্ডলীর ৫ বারের সদস্য, সাবেক উপমন্ত্রী, এমপি এ এফ এম ফখরুল ইসলাম মুন্সী মারা যাওয়ায় তিনি বেকায়দায় পড়েন। 


জাতীয় সংসদের এলডি ভবনে সদ্য সংসদ সদস্য হওয়া আবুল কালাম আজাদকে প্রকাশ্যে ঘুষি মেরে দেশব্যাপী আলোচিত হন রাজী ফখরুল। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা- কর্মীরা এ নিয়ে রাজীর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারই বহিঃপ্রকাশ ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন রাজীকে দেবীদ্বার উপজেলার সূর্যপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিতই নয়, তাকেসহ প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে আটকে রাখেন বিক্ষুব্দ জনতা। পরে ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের উদ্ধার করেন। যা রাজী ফখরুল নিজেই গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়টি জানান। নির্বাচনে রাজী তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আবুল কালাম আজাদের কাছে ১৫ হাজার ৫৫০ ভোটে পরাজিত হন। নির্বাচনে ‘নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রাজী মোহাম্মদ ফখরুল পেয়েছে ৮১ হাজার ২৫৭ ভোট এবং ‘ঈগল’ প্রতীকের স্বতন্ত্র বিজয়ী প্রার্থী পেয়েছে ৯৬ হাজার ৮০৭ ভোট।