প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৫
বাংলাদেশের রেলওয়ে একদিকে যেমন যাত্রী সংকুলান করতে পারছে না, অন্যদিকে টিকিট বিক্রিতে লোকসান গুনছে। দেশের অসংখ্য ট্রেনে যাত্রীর ঠাসা ভিড় দেখা গেলেও, রেলের পরিসংখ্যান বলছে প্রায় ১৫ শতাংশ টিকিট অবিক্রিত থেকে যায়। এমন এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে দেশের রেল খাত লোকসানের চক্রে আটকে আছে। গত অর্থবছরে রেলওয়ে প্রায় ২,৪৫৫ কোটি টাকার বিশাল লোকসান দিয়েছে, যেখানে ব্যয় ছিল ৩,৯০০ কোটি টাকা এবং আয় ছিল মাত্র ১,৪৪৫ কোটি টাকা।
যাত্রী পরিবহণের চিত্রটি আরও জটিল। আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটগুলো অনলাইনে বিক্রি শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু লোকাল, মেইল এবং কমিউটার ট্রেনগুলোতে ছাদ, বগির সংযোগস্থল এবং ইঞ্জিন পর্যন্ত যাত্রীতে পূর্ণ থাকে। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, টিকিট না কেটেই বিপুল সংখ্যক যাত্রী এসব ট্রেনে যাতায়াত করেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে রেল কর্মীরা প্রায়শই লাঞ্ছিত হন, যা এই সমস্যাকে আরও গভীর করেছে।
দেশের রেল যোগাযোগের এই অবস্থার পেছনে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা একটি বড় কারণ। বর্তমানে ২৮১টি ট্রেন চলাচল করছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন। গত ১৫ বছরে ১৪২টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে এবং ৪৪টি রুট বাড়ানো হয়েছে। রেলের অভ্যন্তরীণ সূত্রমতে, এসব সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে, যা রেলের আর্থিক লাভালাভের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে আন্তঃনগর ট্রেনে ২৪ থেকে ৩৪টি কোচ ব্যবহার করা হলেও, বাংলাদেশে মাত্র ৯ থেকে ১৬টি কোচ দিয়ে ট্রেন চালানো হয়। লোকাল ও কমিউটার ট্রেনগুলোতে কোচের সংখ্যা আরও কম, ৪ থেকে ৮টি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি যথাযথ সংখ্যক কোচ ব্যবহার করা হতো, তাহলে রেলের আয় অন্তত দ্বিগুণ বাড়ানো সম্ভব ছিল। বর্তমানে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন থেকে বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা আয় হয়, যা পর্যাপ্ত কোচের অভাবে অনেকটাই কমে যাচ্ছে।
যাত্রী পরিবহণের পাশাপাশি পণ্য পরিবহণেও রেলের ভূমিকা নগণ্য। একসময় সিমেন্ট, সার, পাট ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য পরিবহণে রেলের গুরুত্ব ছিল। বর্তমানে মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ পণ্য রেলপথে পরিবহণ করা হয়, যেখানে চাহিদা অনেক বেশি। পণ্য পরিবহণের এই খাতটিকেও যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না, যা রেলের আয়ের একটি বড় উৎস হতে পারত।
রেলের আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সময় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রেলের সাবেক মহাপরিচালক মনে করেন, যদি বিনা টিকিটে ভ্রমণকারী যাত্রীদের কাছ থেকে টিকিট নিশ্চিত করা যায়, তাহলে প্রতিদিন কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। ২০০০ সালের দিকে রেলের কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ছিল, যার মাধ্যমে তারা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করতেন। সেই ক্ষমতা হারানোর পর বিনা টিকিটে ভ্রমণের প্রবণতা বেড়েছে।
পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কনটেইনার ও মালামাল পরিবহণ বাড়িয়ে এবং রেলের অব্যবহৃত জমি ইজারা দিয়ে আয় বাড়ানো সম্ভব। হাজার হাজার একর জমি এখনো বেদখলে রয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষও স্বীকার করে যে আয় বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি এবং অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যাপ্ত রোলিংস্টক সামগ্রী পেলে এই আয় অনেক বৃদ্ধি পাবে।