সহিংসতায় যে ১৫৬ জন মারা গেছেন তার অধিকাংশ সাধারণ মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক
মোঃ সাইফুল ইসলাম, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশিত: সোমবার ২৯শে জুলাই ২০২৪ ০৯:১০ পূর্বাহ্ন
সহিংসতায় যে ১৫৬ জন মারা গেছেন তার অধিকাংশ সাধারণ মানুষ



গত কয়দিনের সহিংসতায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ১৫৬ জন মারা গেছেন বলে ইনিউজ৭১ তথ্য পেয়েছে তাদের বেশিরভাগই পথচারী। এ ছাড়া আছে শিশু, শিক্ষার্থী, দিনমজুর, দোকান কর্মচারী। তাছাড়া পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকও আছেন নিহতদের তালিকায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের তালিকা থেকেও এমন ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। 



ঢাকা মেডিকেল সূত্র জানায়, গত ১৫ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ ও শারীরিক আঘাত পেয়ে মৃত্যু হয়েছে এমন ৭৪ জনের তালিকা আছে সেখানকার মর্গে। নিহতদের বেশিরভাগই ঢাকা মহানগর ও কাছাকাছি এলাকায় সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন। মর্গের ওই তালিকা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, নিহতের মধ্যে ৪৮ জন পথচারী, আটটি শিশু, শিক্ষার্থী তিনজন, পুলিশ একজন ও সাংবাদিক একজন। বাকি ১৩ জনের মধ্যে আটজনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। পাঁচজনের নাম পেলেও বিস্তারিত পরিচয় নেই।



ঢাকা মেডিকেলের মর্গের তালিকার বাইরেও আরও একজন সাংবাদিক, শিক্ষার্থী ও দুজন পুলিশ নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। মর্গের তালিকা অনুযায়ী, যাত্রাবাড়ী এলাকায় সহিংসতায় মৃত্যু বেশি। টানা পাঁচ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ যাত্রাবাড়ী থেকে ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে নারায়ণগঞ্জের মৌচাক পর্যন্ত। গত ১৮ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত এই এলাকায় ৩৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ২৮ জন পথচারী, ছয় শিশু, একজন শিক্ষার্থী, দুজন পুলিশ ও একজন সাংবাদিক। এরপর বেশি নিহত হয়েছে বাড্ডা, রামপুরা ও ভাটারা এলাকায়। এ এলাকায় নিহতের সংখ্যা ১১। তাদের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী ও বাকি ১০ জন পথচারী। সায়েন্স ল্যাব, নিউ মার্কেট ও আজিমপুর এলাকায় নিহতের সংখ্যা ছয়। তাদের মধ্যে পথচারী চারজন, শিক্ষার্থী একজন ও শিশু একটি। মোহাম্মদপুর-বসিলা এলাকায় মারা গেছে তিনজন।



 তাদের মধ্যে একটি শিশু, বাকিরা পথচারী। পল্টন ও মিরপুরে দুজন করে চারজন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন পথচারী। একজন মারা গেছেন সংঘর্ষের সময় ছোড়া গুলি বাসায় ঢুকে।উত্তরায় মারা গেছেন ১১ জন। এ এলাকায় গাজীপুরে সাবেক মেয়রের সহকর্মী নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একজন চিকিৎসকও আছেন। তিনি তার ভাইকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এসে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মারা গেছেন।



গাজীপুরে মারা গেছেন চারজনই পোশাক শ্রমিক। তারা কারখানায় আসা-যাওয়ার সময় মারা গেছেন।ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা সাভারে দুই শিক্ষার্থীসহ ১০ জন মারা গেছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলায় সহিংসতায় এক শিশু ও আট শ্রমিক মারা গেছেন। সংঘর্ষের সময় ছোড়া গুলি লেগে শিশুটি নিহত হয়েছে বাসার ছাদে।এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল সূত্রে জানা গেছে, চার শিক্ষার্থীসহ ছয়জন মারা গেছেন। বাকি দুজন পথচারী।



নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন আর হয়নি। দেশকে রক্ষা করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অ্যাকশনে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ওই সময় অনেকে মারা গেছেন তা সত্য। আমরাও তথ্য পাচ্ছি, নিরীহ লোকজনও মারা গেছেন।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পুঁজি করে তৃতীয়পক্ষ (বিএনপি-জামায়াত) তা-ব চালালেও তাদের কোনো নেতা বা কর্মী হতাহত হয়নি। তারা ছিল প্রশিক্ষিত। তারা এমনভাবে ছিল, সংঘর্ষ হলেও তাদের শরীরে আঁচড়ও লাগেনি। মাঝে নিরপরাধ লোকজনের প্রাণহানি ঘটেছে।’



ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তা-বের ধরন দেখলেই বোঝা যায়, শিক্ষার্থীরা এই কাজ কিছুতেই করতে পারে না। বিএনপি-জামায়াত এসব অপকর্ম করেছে। তারা পুলিশকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেছে। তিন পুলিশকে মেরে ফেলেছে। অসংখ্য পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এই দুটি দলের গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীরাও তা-বের কথা স্বীকার করেছেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। উসকানিদাতাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছে।’


নিহত পথচারী : ঢাকা মেডিকেল মর্গ সূত্রে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী এলাকায় নিহত হয়েছেন পথচারী মো. হোসাইন, সোহাগ, হাবিব, ইউসুফ মিয়া, ছানোয়ার, আরিফ, ইমাম হোসেন তায়েম, ইউসুফ আলী শাওন, সোহেল, জিসান, আব্দুল আহাদ, মোশারফ, শরীফ, ইব্রাহীম, ইমন, তাহের জামান, শাকিল, আব্দুল্লাহ, বাঁধন, জিহাদ হোসেন ও ইসমাইল হোসেন। বাড্ডা-রামপুরা এলাকায় মারা গেছেন পথচারী আব্দুল হান্নান, আব্দুল আল আবির, তরিকুল ইসলাম, মনির হোসেন, মায়া ইসলাম, মারুফ, মেহেদী, রবিউল ইসলাম ও আব্দুল গণি শেখ। নিউ মার্কেট, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পল্টন ও উত্তরা এলাকায় শাজাহান, সবুজ আলী, খালিদ হাসান, মো. রাব্বি, ওমর ফারুক, আব্দুল ওয়াদুদ, পারভেজ, নবীন তালুকদার, কামাল মিয়া, শোভন, হাসান, দুলাল মাহমুদ, তাহের জামান, কবির, শাকিল, রাজিব হোসেন, শুভ, হাবিব, শাকিল পারভেজ, ডা. সজীব সরকার ও রাহাত হোসেন নিহত হয়েছেন, তারা কেউ রাজনীতি করতেন না বা আন্দোলনে যাননি বলে পরিবার সূত্রে জানা গেছে। 



এ ছাড়া নিহতদের মধ্যে কয়েকজনের পেশা জানা গেছে। তাদের স্বজনরাও দাবি করেছেন, তারা সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে অথবা দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে বা আঘাত পেয়ে মারা গেছেন। তারা হলেন নিরাপত্তাকর্মী ছাদেক আলী, গাড়িচালক বাচ্চু, মাছ ব্যবসায়ী ওয়াসিম, ফল ব্যবসায়ী নাজমুল, রাজমিস্ত্রি গনি শেখ, ডেলিভারিম্যান সোহাগ, দোকান মালিক মোবারক, হোটেল কর্মচারী আরিফ, শান্ত। সংঘর্ষ দেখতে গিয়ে শিশু আল আমিন, দোকান কর্মচারী রানা, ফারুক ও বাসার ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশু রিয়া ঘোষ মারা গেছে। ইন্টারনেট দোকানের কর্মচারী সাজিদুর রহমান, বিক্রয়কর্মী শাজাহান, গার্মেন্টস শ্রমিক জামান মিয়া, ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী ওমর ফারুক, মুদির দোকানের কর্মচারী সাইমন, টেইলার্স দোকানের কর্মচারী জাকির হোসেন ও গাড়িচালক সোহেল রানা সংঘর্ষ দেখতে গিয়ে বা সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেলসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কয়েক হাজার লোক। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই পথচারী।



নিহত শিক্ষার্থী : সহিংসতার সময় গুলিতে বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। দেশ রূপান্তর যাদের তথ্য পেয়েছে তারা হলেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আবু সাঈদ, চট্টগ্রামের ওমরগণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ফয়সাল আহমেদ শান্ত, চট্টগ্রাম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ওয়াসিম আকরাম, নরসিংদীর কাদির মোল্লা হাই স্কুলের তাহমিদ তামিম, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি)



শেখ আসসাবুল ইয়ামিন, গাজীপুর ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির জাহিদ্দুজ্জামান তানভিন, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের মীর মাহফুজুর

রহমান মুগ্ধ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইরফান ভূঁইয়া, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শাহ নেওয়াজ ফাহাদ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শাকিল পারভেজ, টঙ্গী সরকারি কলেজের শেখ ফাহমিন জাফর, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ফারহান ফাইয়াজ, ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজের জিল্লুর শেখ, মাদারীপুর সরকারি কলেজের দীপ্ত দে, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রুদ্র সেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের তাসাউফ উল আলম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ও চট্টগ্রাম পটিয়া সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের মোহাম্মদ ইমাদ।



চার সাংবাদিক ও তিন পুলিশ নিহত : সহিংসতার ঘটনায় চার সাংবাদিক ও তিন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। তাছাড়া অর্ধশত সাংবাদিক ও দেড় হাজার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। নিহত সাংবাদিকরা হলেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ঢাকা টাইমস’-এর প্রতিবেদক হাসান মেহেদী ও ‘দ্য রিপোর্ট ডট লাইফ’ অনলাইনের সাবেক ফটোসাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়, দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকার গাজীপুরের গাছা থানা প্রতিনিধি মো. শাকিল হোসেন ও দৈনিক নয়াদিগন্তের সিলেট প্রতিনিধি এটিএম তুরাব। নিহত পুলিশ সদস্যরা হলেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ, ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মোক্তাদির ও নায়েক গিয়াস উদ্দিন। 



কয়েকজন পথচারীর মৃত্যুর ঘটনা : গত ২০ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বড় ভাইকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে শনির আখড়া এলাকার বাসায় ফিরছিলেন ইউসুফ। শনির আখড়া মোড়ে অটোরিকশা থেকে নামতেই সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন তারা। কোনো কিছু বোঝার আগেই ইউসুফের তলপেটে একটি গুলি লাগে। ঢাকা মেডিকেলে আনার পর তার মৃত্যু হয়। নিহত ইউসুফ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেলসম্যানের চাকরি করতেন।


একই দিন রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় রিকশাচালক কামাল হোসেনের গায়ে গুলি লাগে। তিনি বাসায় রিকশা রেখে রাস্তায় সংঘর্ষ দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন মারা যান।গত ১৯ জুলাই বিকেলে সংঘর্ষের সময় নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকার নিজ বাসার ছাদে গিয়েছিল শিশু রিয়া ঘোষ। এ সময় হঠাৎ তার মাথায় গুলি লাগে।  রিয়া স্থানীয় একটি স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। একই দিন প্রাণ আরএফএল কোম্পানির বিক্রয়কর্মী শাজাহান কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর মহাখালীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। নরসিংদীতে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী গার্মেন্টস শ্রমিক জামালও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।


আহতরা বেশিরভাগই পথচারী : ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের বেশিরভাগই পথচারী। গত ১৯ ও ২০ জুলাই সংঘর্ষের সময় বিভিন্ন কাজে বের হয়ে বা কাজ শেষে ঘরে ফিরতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ সংঘর্ষ দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বাসাবাড়িতে বসেও অনেক নিরীহ মানুষও গুলিবিদ্ধ হন। বাড্ডায় আট বছরের শিশু ইমন রাস্তায় সংঘর্ষ দেখতে গেলে তার পায়ে গুলি লাগে। এক পা স্বাভাবিক হলেও আরেক পা ভালো না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। রিকশাচালক সাগরও যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে যাওয়ার সময় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন।



বাড্ডা লিংক রোডে সংঘর্ষ দেখতে এসে গুলিবিদ্ধ হন জাকির হোসেন। তার বাম পায়ের ঊরুর নিচের অংশের হাড় ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেছে। তিনি একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করতেন। এমন অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে বসে আছেন। এ ছাড়া ময়মনসিংহের শিমুল আহম্মেদ, কুমিল্লার নাসির উদ্দিন, ঝালকাঠির আবির, শরীয়তপুরের মেহেদী, নড়াইলের শীতল, ভোলার সিফাত, মাদারীপুরের নেসার উদ্দিন, বরগুনার ছাত্রলীগের কর্মী কাওসার, পুলিশ সদস্য রাসেল ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।