প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২৩:৪
আর এক দিন পরেই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আর এই দিবস ঘিরে ফুলের বাজারে গোলাপের চাহিদা বরাবরই থাকে তুঙ্গে। প্রিয়জনকে একটি গোলাপ কিনে উপহার দিতে চান না এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম। তাইতো প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারী ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে ফুলের ভালো দাম পেতে আশায় বুক বেঁধে থাকেন সাভারের ফুল চাষীরা।
কিন্তু এবছর বিধি বাম। গোলাপ গ্রাম খ্যাত বিরুলিয়া ইউনিয়নের গ্রাম গুলোতে দেখা মিলছে না গোলাপের। হেক্টরের পর হেক্টর গোলাপ বাগান গুলোতে এখন শুধুই হাহাকার। অসময়ে বৃষ্টিপাত ও কুয়াচ্ছান্ন শীতের আবহ কেড়ে নিয়ে কৃষকদের হাসি। বাগান গুলোতে যতদূর দৃষ্টি যায় গোলাপ নেই বললেই চলে। অজানা রোগে শুকিয়ে যাচ্ছে গাছের কুড়ি, কচি ডালপালাসহ ফুলের কলি। মাঝে মধ্যে দুই-একটা কলি বেড়ে উঠলেও তা কালো রঙ ধারণ করে আস্তে আস্তে পঁচে শুকিয়ে যাচ্ছে।
চাষীরা বলছেন, ইউনিয়নের শ্যামপুর, মোস্তাপাড়া, বাগ্নীবাড়ি, কালিয়াকৈরসহ সব গুলো গ্রামেই বাগান গুলোর একই অবস্থা। ২০১৭ সালের মড়ক লেগে তাদের বাগানের সব ফুল ও গাছ মরে গিয়েছিল। এবছর গাছ মারা না গেলেও বাগান থেকে ফুল পাচ্ছেন না তারা। সব ফুল পঁচে শুকিয়ে যাচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকেও তারা কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় ফুলের এই ভরা মৌসুমে চরম আর্থিক লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।
গোলাপ গ্রাপ খ্যাত বিরুলিয়া ইউনিয়নের প্রায় সব গুলো বাগান ঘুড়ে একই চিত্র দেখা গেছে।শ্যামপুর গ্রামের পুরাতন ফুল চাষী মনির হোসেন। প্রতিবছরের মত এবারও ৬০ শতাংশ জমিতে ঋণ নিয়ে গোলাপের চাষ করেছেন তিনি। কিন্তু তার সব গুলো বাগানেই কোন ফুলের দেখা পাননি। গত এক মাস ধরে বাগানের এমন করুন পরিস্থিতিতে নির্বাক মনির হোসেন।
তিনি ইনিউজ ৭১কে বলেন, ২০১৭ সালে একবার এমুন হইছিলো। এলাকার সবার বাগানে অজানা রোগে গাছ আর ফুল মইরা মইরা শুকায় গেছিলো। তখন সবাই মিইল্লা দিশা হারায় ফালাইছিলাম। অনেক গাছ নষ্ট হইয়া মইরা গেছিলো আমার বাগানে। ওই ঘটনার পর ঋণ কইরা আবার বাগান দাগ করাইছি। এই বছর আবোর ওই রকম রোগ দেহা দিছে বাগানে। গাছের কচি ডাল, কুড়ি, কলি পঁইচা শুকায় যাইতেছে। কোন কিছুই বুঝবার পাইতেছি না। জমিতে পটাশ সার, নিড়ানি দিতাছি। কিন্তু বাগান থাইকা কোন প্রকার ফুল বিকতে পারতাছি না। প্রতি বছর এই সুম (সময়) একেকটা বাগান থাইকা ২৫০০-৩০০০ কইরা ফুল কাটছি। আর এই বছর তিন দিন পর আড়াইশ ফুল কাটছি আইজ। গড়ে ডেইলি ১০০ ফুলও পাই না।'
তিনি আরও বলেন, এইটা আমাগো ফুল ব্যাচার সিজন। আর এহনি বাগানের এই অবস্থা। দুই দিন পর ভালোবাসা দিবস। কিন্তু বাগানের যতদূর চোখ যায় ফুলের দেখা নাই। এহন ঋণের ট্যাকা ক্যামনে শোধ করমু ?একই এলাকার গোলাপ চাষী মালু মিয়ারও ১৫০ শতাংশ জমির করুন দশা। বাগান ফুল না থাকায় দিশেহারা এই চাষী।
মালু মিয়া বলেন, পুরা গোলাপ গ্রামের সবার বাগানের একই অবস্থা। কারও বাগানেই ফুল নাই। সমস্যা সমাধানে তারা নিজেরাই কোনরকম চেষ্টা চালাচ্ছেন বাগান বাঁচানোর। কিন্তু উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তারা কোন সহযোগিতা পাচ্ছেন না। কোন কর্মকর্তাই তাদের ক্ষেত পরিদর্শনে আসেননি এখনও। কিছুদিন আগে পাশের গ্রামে শুধু একটা মিটিং হয়েছিল শুনেছি। কিন্তু আমার মতো অনেক বড় যারা ফুল চাষী তারাই জানি না।
শ্যামপুর গ্রামের গোলাপ চাষী মনির হোসেন ও মালু মিয়ার মত পাশের গ্রাম গুলোর চাষীদেরও আর্থিক লোকসানের মুখে। বাগ্নিবাড়ী গ্রামের আম্বর আলীর ৭০ শতাংশ জমির বাগানে দেখা নেই গোলাপের। এছাড়া মোস্তাপাড়ার সিরাজ উদ্দিনের প্রায় ৬০ শতাংশ ও শুক্কুর আলীর ৭০ শতাংশ গোলাপ বাগানের চিত্র একই।
এদিকে বাগানে ফুল না থাকার প্রভাব পড়েছে সাভারের স্থানীয় ফুলের দোকান গুলোতে। ভালোবাসা দিবসের এক দিন আগে থেকেই তাদের ২৫-৩০ টাকা দরে যশোর থেকে আসা গোলাপ কিনতে হচ্ছে। এত দামে গোলাপ কিনে আরও লাভে তারা বিক্রি করতে পারবেন কি না এ নিয়ে তারাও বেশ শঙ্কায়।
নবীনগর এলাকার ফুল ব্যবসায়ী ময়েজ উদ্দিন বলেন, সাভার ও যশোর থেকে আমাদের এখানে গোলাপ ফুল আসতো। কিন্তু সাভারের বাগান থেকে অনেক দিন ফুল সেরকম ভাবে আসছে না। যার কারণে চাহিদা বেশি থাকায় যশোর থেকে আসা ফুলের বাজার চরা। ২৫-৩০টাকা দরে প্রতিটি ফুল আমাদের কিনতে হচ্ছে। কিন্তু ভালোবাসা দিবসে এই দামে কেনা ফুল বেশি লাভে বিক্রি করা যাবে কি না তাতে সন্দেহ আছে।
সাভার উপজেলা কৃষি অফিস্র নাজিয়াত আহমেদ বলেন, গোলাপ বাগান গুলোর বয়স অনেক পুরনো। ১৫-২৫ বছর বয়সী বাগান আছে। অতিরিক্ত মাত্রায় বছরের পর সার প্রয়োগের কারণে মাটিতে পিএইচ এর পরিমাণ কমে গেছে। ফলে গাছ মাটি থেকে খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না। এছাড়া অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে এবং সকালে কুয়াশা পড়ে শীত বেশি পড়ছে। বর্তমান আবহাওয়াটা ফসল উৎপাদনের অনুকূল নয়। ফলে কচি পাতা এবং ফুল ঝড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত মাত্রায় পানি প্রয়োগও এই ধরণের সমস্যার কারণ।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা কৃষকদের অতিরিক্ত পানি, সার প্রয়োগ করতে নিষেধ করেছি। মাটির পিএইচ বাড়ানোর জন্য কিছু চুন জাতীয় ডলোমাইট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছি। গোলাপের জন্য যে পরিমাণ পিএইচ দরকার সেটা এর মাধ্যমে মাটিতে আনা সম্ভব। কিন্তু ওখানকার কৃষকরা আমাদের কথা শুনছেন না।
উপজেলা থেকে কেউ পরিদর্শনে যাননি এমন অভিযোগের বিষয়ে বলেন, 'আমরাসহ উর্ধতন কর্মকর্তা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা পরিদর্শন করে এসেছি। এছাড়া সব সময়ই ফিল্ড অফিসাররা পরিদর্শন করেন। বিজ্ঞানীরা ওখানকার মাটি ও গোলাপ গাছের পাতা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন মাটির পিএইচ এর পরিমাণ কমে যাওয়াসহ কিছু সমস্যার কথা জানিয়েছেন।'