প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ১১:১১
ইসলামী বছরের বারটি মাসের মধ্যে জিলহজ্জ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত অন্য সব মাসের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। এটি আরবি বর্ষপঞ্জির শেষ মাস, যা মুসলমানদের জন্য ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির এক বিশেষ সময় হিসেবে বিবেচিত। পবিত্র কুরআনে এবং হাদীসে এই মাসের প্রথম দশদিনের ফজিলতের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। এই মাসটি যেমন হজের মাস, তেমনি কোরবানির মাস হিসেবেও মুসলিম উম্মাহর নিকট পরিচিত ও মর্যাদাসম্পন্ন।
জিলহজ্জ মাস চারটি নিষিদ্ধ মাসের একটি, যেগুলোতে ইসলাম যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। মুহাররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ্জ এই চারটি মাস আগে থেকেই সম্মানিত ছিল, এমনকি জাহেলিয়াত যুগেও। ইসলামের আগমনের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) এই নিষিদ্ধ মাসগুলোর মর্যাদা আরও সুসংহত করেছেন এবং তাদের পূর্ণতা দিয়েছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশনা অনুযায়ী। এই মাসে হজ পালন, কোরবানি, তাকবির, রোযা ও অন্যান্য নফল ইবাদতের মাধ্যমে মুসলমানরা আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করেন।
বিশ্বের সামর্থ্যবান মুসলিমদের জন্য হজ একটি ফরজ ইবাদত, যা জিলহজ্জ মাসেই আদায় করা হয়। হজের মূল রুকনসমূহ যেমন আরাফায় অবস্থান, ইহরাম পরিধান, ও কাবা শরিফে তাওয়াফ, সবই এই মাসে সংঘটিত হয়। বিশেষ করে আরাফার দিন, অর্থাৎ ৯ জিলহজ্জ, হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই দিনে হজ পালনকারী মুজতামা আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি ও দোয়া-মুনাজাতে রত হন। হাদীসে এসেছে, এই দিনেই আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে বেশি গোনাহগারকে ক্ষমা করেন।
আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, “জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় দিন। এ সময়ে প্রতিটি সৎকর্মের জন্য তিনি অসংখ্য সওয়াব দান করেন।” (মেশকাত)। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, “এই দশদিনের প্রতিটি দিনের রোযা এক বছরের রোযার সমপরিমাণ এবং রাতের ইবাদত শবে কদরের মতো।” (মুকাশফাতুল কুলুব)। বিশেষত ৯ জিলহজ্জ অর্থাৎ আরাফার দিনের রোযার ফজিলত হলো, আল্লাহ তায়ালা এর দ্বারা বিগত এবং আগত এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেন, তবে হজ পালনকারীদের জন্য এই রোযা রাখা নিষিদ্ধ।
১০ জিলহজ্জ কোরবানির দিন হিসেবে মুসলিম বিশ্বের নিকট বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। এই দিনে হযরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য নিজের পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করার জন্য প্রস্তুত হন। মহান আল্লাহ তাঁর এই আনুগত্যে সন্তুষ্ট হয়ে পুত্রের পরিবর্তে একটি জানোয়ার পাঠিয়ে দেন। ইসলামে এই ঘটনার স্মৃতিচারণ হিসেবে প্রতি বছর কোরবানি করা ফরজ নয়, বরং সুন্নতে মুআক্কাদা, তবে যারা সামর্থ্যবান অথচ কোরবানি করেন না তাদের জন্য কঠোর সতর্কবাণী রয়েছে। হাদীসে এসেছে, “যার কোরবানির সামর্থ্য রয়েছে অথচ সে কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।” (ইবনে মাজাহ)
আল্লাহ তায়ালা সূরা ফজরের শুরুতে ফজরের এবং দশ রাতের কসম করে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিনের গুরুত্ব প্রতিপাদন করেছেন। অধিকাংশ মুফাসসিরগণ একমত, এ দশ রাত্রিই হচ্ছে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ রাত্রি। এই দশকে হযরত আদম (আ.) এর ক্ষমা লাভ, হযরত ইবরাহিম (আ.) এর খলিলুল্লাহ হওয়া, কাবা শরিফ নির্মাণ, মূসা (আ.) এর আল্লাহর সাথে কথোপকথন এবং বায়াতে রিযওয়ানের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
এই দশ দিনে ইবাদতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন—তাকবির বলা, দান-সদকা, কুরআন তেলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, দোয়া-মুনাজাত, এবং বিশেষভাবে রোযা রাখা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যারাই এই আমলগুলো করবে, তাদের জন্য রয়েছে অগণিত সওয়াব। এ মাসে কোরবানি করার মাধ্যমে শুধু পশু নয়, বরং মনের ভেতরকার অহংকার ও গোনাহের প্রবণতাকে জবাই করার শিক্ষা দেয় ইসলাম।
জিলহজ্জ মাস শুধু ইবাদতের নয়, বরং আত্মসমর্পণ, ত্যাগ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক পূর্ণাঙ্গ অধ্যায়। হযরত ইবরাহিম (আ.) এবং ইসমাইল (আ.) এর দৃঢ়তা, আনুগত্য ও কোরবানির এই চেতনা মুসলমানদের অন্তরে গেঁথে দেয়া জরুরি। কোরবানির মাধ্যমে আমরা শিখি, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করাও একটি ইবাদত।
সুতরাং এই পবিত্র মাসের মর্যাদা বুঝে আমাদের উচিত, এই দশদিন বিশেষভাবে ইবাদত বন্দেগিতে মনোনিবেশ করা, হালাল-হারাম মেনে চলা এবং নিজের আচার-আচরণে ইসলামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এই বরকতময় মাসের গুরুত্ব বুঝে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।